পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের ওপরে ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক দলের কীভাবে দ্রুত বৃদ্ধি হলো, তা নিয়ে এই রাজ্যে নানান চর্চা কয়েক বছর ধরেই চলছে। অনেক বিশ্লেষণই এই উত্থানের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করেছে। তাঁর ভূমিকা যে একটা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেটা অনেক কারণের একটি মাত্র, একমাত্র নয়। মমতার জায়গায় অন্য দল থাকলেও এই শক্তিকে ঠেকানো যেত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিষয়টি একটু পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা যাক।
অবিভক্ত বাংলায় বহু আগে থেকেই একটা হিন্দুত্ববাদী ধারা ছিল। কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক বিশিষ্টরাই উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে গিয়ে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ইউরোপের জাতীয়তাবাদী চেহারা দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এদের অনেকেই আবার হিন্দুত্ববাদী ও সশস্ত্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন, যার মূলে ছিল মুসলমানবিরোধিতা। এর কারণ তেরো শতকের গোড়ায় বাংলায় ইসলাম আসে এবং প্রথম দশকের মধ্যেই এখানে ইসলামের শাসন কায়েম হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে এটা ভুলে যাওয়া মুশকিল যে দীর্ঘ ৫৫০ বছর মুসলমান তাদের ওপরে প্রভুত্ব করেছে। এই শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে চলেছিল ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশের হাতে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত। অতএব ২০২১ সালের হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয়েছে বহু আগেই।
তবে আবার এই বাংলাতেই এমনটা দেখা গিয়েছে যে একই পরিবারের এক ভাই হিন্দুত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত আবার অপর ভাই বামপন্থী। স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ও তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কথাই ধরা যাক। বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দুত্বের একজন পতাকাবাহক আর ভূপেন্দ্রনাথ ভারতে বিপ্লব কীভাবে করা সম্ভব, তা নিয়ে রীতিমতো রিপোর্ট লিখে রাশিয়া গিয়ে লেনিনকে জমা দিয়ে এসেছিলেন। এই রকম উদাহরণের শেষ নেই। অতএব একদিকে খ্রিষ্টধর্ম অনুপ্রাণিত জাতীয়তাবাদ বাঙালি যুবককে অনুপ্রাণিত করেছে, আবার অন্যদিকে করেছে সাম্যবাদ।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের বৃদ্ধির প্রধান কারণ নরেন্দ্র মোদির মতো প্রবল ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকা একজন নেতার উঠে আসা। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, বিজেপি অবশ্যই নির্বাচনে জিততে চায়, কিন্তু শুধু নির্বাচনে জেতাটাই তাদের লক্ষ্য নয়। জেতাটা জরুরি, তবে তারপরও তাদের একটা আদর্শ আছে।
একটি তৃতীয় ধারাও রয়েছে। এই তৃতীয় ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুসলমান সমাজের বড় কৃষক, ছোট কৃষক ও কখনো-সখনো জমিদারেরা, যাঁদের মধ্যে একজন মীর নিসার আলী বা তিতুমীর, যিনি কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বারাসাতে এক ভয়ংকর লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।
এই তিন ধারার মধ্যে স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গে জিতে গেল বামপন্থীরা। যদিও এটা ভুললে চলবে না ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের প্রথম নির্বাচনে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো ১৩টি আসন পেয়েছিল। এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিজেপি অত আসন জেতেনি। অন্যদিকে, বামপন্থীরা ১৯৫১-৫২ সালে পেলেন ৪১টি আসন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি প্রভাবিত খাদ্য আন্দোলন, দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে উদ্বাস্তুদের জায়গা-জমি নিয়ে সংকট ও বামেদের ইতিবাচক ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে হওয়া তেভাগা আন্দোলন—মোটামুটিভাবে এই তিনের ফলে বামপন্থীরা এতটাই এগিয়ে গেলেন যে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা আর তাঁদের নাগাল পেলেন না। হিন্দুত্ববাদী ধারাটি জল না পাওয়া গাছের মতোই নুয়ে পড়ল, কিন্তু তার শিকড় অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) রয়েই গেল। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, আরএসএস ভেতরে-ভেতরে নিজেদের অনেকটাই মজবুত করেছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের এটা একটা বড় কারণ।
তবে এটা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের বৃদ্ধির প্রধান কারণ নরেন্দ্র মোদির মতো প্রবল ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকা একজন নেতার উঠে আসা। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, বিজেপি অবশ্যই নির্বাচনে জিততে চায়, কিন্তু শুধু নির্বাচনে জেতাটাই তাদের লক্ষ্য নয়। জেতাটা জরুরি, তবে তারপরও তাদের একটা আদর্শ আছে। আদর্শটা হলো সমাজ পরিবর্তনের, যে সমাজের ভিত্তি হবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সেই অর্থে বিজেপি একটি দক্ষিণপন্থী বিপ্লবী দল, যেমন কমিউনিস্ট পার্টি একটি বামপন্থী বিপ্লবী দল। বিজেপির বিপ্লবী ও হিন্দুত্ববাদী চরিত্র মানুষ গ্রহণ করল, প্রথমে উত্তর ভারতে আর তারপর ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গে। এটাই বাংলায় বিজেপির উত্থানের প্রধান কারণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন, কারও পক্ষেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে হিন্দুত্ববাদের এই সুনামিকে ঠেকানো সম্ভব হতো না। তবে মমতা যে কিছু ভুল করেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সংক্ষেপে তিনটি ভুলের কথা বলা যায়।
এক. ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী দল সিপিআইএমের সদস্যদের মারধর করতে শুরু করল। সিপিএমের সমর্থকেরা প্রাণে বাঁচতে বিজেপিতে চলে গেলেন আর বিরোধীশূন্য রাজনৈতিক অঙ্গন দখল করল বিজেপি।
দুই. বিজেপির মতো সংগঠনকেন্দ্রিক দলের সঙ্গে লড়াই করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরকার ছিল একটি সংগঠনকেন্দ্রিক দলের। কিন্তু সেটার ওপরে তিনি খুব একটা জোর দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় ঢুকে ছিল পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি না হওয়ার প্রধান কারণ সিপিআইএম দলের সংগঠনকেন্দ্রিক রাজনীতি। ক্ষমতায় এসে তিনি পার্টিকে এড়িয়ে প্রশাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বণ্টনের কাজ শুরু করেন। এতে সরকারের পরিষেবা ভালো হলেও পার্টি দুর্বল হয়ে পড়ল।
রাজনৈতিক দলের কাজটা শুধুই এনজিওর মতো পরিষেবা দেওয়া নয়, দলকে চাঙা রাখতে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রয়োজন। সেই কর্মসূচির অভাবে তৃণমূল পার্টিটা অনেকটা গুটিয়ে গেল।
একটি রাজনৈতিক দলের জন্য যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিরোধী দল সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা, সেই কাজটা তৃণমূল প্রায় করতই না। বছর চারেক আগে আমি দেখেছি ও লিখেছি, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কিছু মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের সদস্য আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের হয়ে প্রচার করছে। তৃণমূল এসবের খোঁজখবর রাখেনি, রাজনৈতিকভাবে লড়াই করার চেষ্টাও করেনি। এরাই পরে বিজেপিতে যোগ দেয়।
রাজনৈতিক দলের কাজটা শুধুই এনজিওর মতো পরিষেবা দেওয়া নয়, দলকে চাঙা রাখতে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রয়োজন। সেই কর্মসূচির অভাবে তৃণমূল পার্টিটা অনেকটা গুটিয়ে গেল। এটা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখে বুঝলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘এত দিন সরকারকে সময় দিয়েছি, এবার দেব সংগঠনকে।’ কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, সংগঠন সামলাতে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে রাজনৈতিক রণকৌশলনির্ধারক প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে আসতে হলো। কিশোরের কাজটা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠনটাকে সামলে বিজেপির উত্থান নিয়ন্ত্রণ করা। তিনি এটা কতটা করতে পেরেছেন, সেটা ২০২১ সালের নির্বাচনে বোঝা যাবে।
তিন. মমতার সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুল তাঁর বিভ্রান্তিকর মুসলিমনীতি। বিরোধীরা বলেন তোষণের নীতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে এটা জানতেন না যে এই রাজ্যে ‘হিন্দু-মুসলিমের স্বার্থ কখনোই এক রাস্তায় হাঁটে না।’ (মুসলিম পলিটিকস অব বেঙ্গল, ১৯৩৭-১৯৪৭। শীলা সেন) এটা স্বাধীনতার আগে থেকেই চলে আসছে।
মমতা ক্ষমতায় এসেই কী করলেন? তিনি রাতারাতি মুসলিম সমাজের দাওয়াতে গিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, সেই ছবি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল। কথায় কথায় তিনি নানা ধরনের আরবি বাক্যবন্ধ আওড়াতে শুরু করলেন। হিন্দু সম্প্রদায় আরও খেপে গেল। তারপর মুসলমান সমাজের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের একটা ছোটখাটো ভাতা দিয়ে বসলেন।
এটা মমতা কেন করলেন, এর একটা ব্যাখ্যা আছে। তৃণমূলের মুসলিম নেতাদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে গেলে মুসলমান ভোট ছাড়া গতি নেই। আংশিকভাবে কথাটা সত্যি, কারণ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ২৭ শতাংশ। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্যি যে উল্টো দিকে হিন্দু ভোট ৭০ শতাংশ।
এই ৭০ শতাংশের বড় অংশ এক হয়ে গেলে হিন্দুত্ববাদী দলের জয় নিশ্চিত। সেটাই হলো ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে, যখন বিজেপি প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন পেল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে বিজেপি পেয়েছিল হিন্দু ভোটের মাত্র ২১ শতাংশ, সেখানে ২০১৯ সালে তারা পেল ৫৭ শতাংশ। ভোটের সম্পূর্ণ মেরুকরণ ঘটে গেল। এটা চিন্তায় ফেলল মমতাকে। তিনি রাতারাতি ঘুরে গেলেন। ভাতা দিতে শুরু করলেন হিন্দু পুরোহিতদের। এবারের বিধানসভায় মুসলমানদের মনোনয়ন দিয়েছেন আগের তুলনায় কম।
বিজেপি ধারাবাহিকভাবে মুসলমান নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে থাকল। এই ভীতি হলো পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। বিজেপির তাত্ত্বিকেরা বই লিখলেন, পশ্চিমবঙ্গ ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলাদেশ হয়ে যাবে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনী ইশতেহারে ‘মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহার করলেন মাত্র দুবার (তথ্য-গবেষক সাবির আহমেদ)। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমান সমাজের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছেন, যা অতীতের সরকার করেনি। যেমন, ছাত্রদের স্কলারশিপ দেওয়া বা বিধানসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব ১৫ শতাংশ থেকে একবারে ২০১১ সালে ২০ শতাংশ করা, কিছুটা হলেও সমাজজীবনে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু বিভ্রান্তিকর নীতির ফলে এই কাজগুলো চাপা পড়ে গেল, লাভটা হলো বিজেপির।
বিজেপি ধারাবাহিকভাবে মুসলমান নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে থাকল। এই ভীতি হলো পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। বিজেপির তাত্ত্বিকেরা বই লিখলেন, পশ্চিমবঙ্গ ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলাদেশ হয়ে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করাতে বিজেপি সামনে নিয়ে এল নাগরিক পঞ্জির বিষয়টি, যা দিয়ে তারা চিহ্নিত করতে চাইল কে নাগরিক আর কে নাগরিক নয়। এসবের ফলে ভীতি আরও বাড়ল।
অন্যদিকে, একদল সমাজবিজ্ঞানী বারবার তথ্য দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের সংখ্যাবৃদ্ধির বা অনুপ্রবেশের তত্ত্বকে খারিজ করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। কারণ, মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে, যেটা সে বিশ্বাস করতে চায়। এ অবস্থায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির বিজেপির তত্ত্বটি সার্বিকভাবে মানুষ মেনে নিল। বিজেপির ভোট বাড়তে থাকল। মমতা এর দায় এড়াতে পারেন না।
তবে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভ্রান্তিকর নীতির জন্যই এটা হলো, এমনটা বলা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের পেছেন আরও অনেক কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। এই উত্থান তাদের ক্ষমতায় আনার জন্য যথেষ্ট কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।