২০১৬ সালের ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এশিয়া-ইউরোপ বিস্তৃত তাঁর সুবিশাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের পর্যটনকেন্দ্র মারামিসে সপরিবারে পাঁচ দিনের অবকাশ যাপন করছিলেন। অকস্মাৎ সেদিন রাত ১০টায় তাঁর কাছে খবর এল যে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন এবং আঙ্কারার সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্র তাঁরা ইতিমধ্যে দখল করে ফেলেছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আর তাঁর সহযাত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের আবাসস্থল পরিত্যাগ করে জীবন রক্ষা করলেন।
অতঃপর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর স্মার্ট মুঠোফোনের মাধ্যমে একটি বেসরকারি টেলিভিশন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন এবং তাঁর মুঠোফোনের মাধ্যমে আঙ্কারা আর ইস্তাম্বুলের নাগরিকদের রাস্তায় বেরিয়ে এসে এই অভ্যুত্থান প্রতিহত করার জোরালো আহ্বান জানালেন। বললেন, তাঁরা যেন আঙ্কারা আর ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর দখল করেন। তাঁর এই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিরস্ত্র নাগরিকের ঢল নামল সেই দুই নগরীর কেন্দ্রস্থলে আর বিমানবন্দর দুটিতে। জনশক্তির কাছে পরাভূত হলো অস্ত্রশক্তি। তুরস্ক এবং গোটা বিশ্ববাসী টেলিভিশনের পর্দায় এই নাটকীয় ঘটনার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। সেই রাতের ঘটনাবলির সাক্ষী রইল আধুনিক প্রযুক্তির দান, ছোট একটি মুঠোফোনের ক্ষমতা আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার।
এর কয়েক ঘণ্টা পরই ১৬ জুলাই শনিবার ভোরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সদলবলে বিমানে করে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ততক্ষণে তাঁর হাজার হাজার অনুসারী ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর করায়ত্ত করে ফেলেছেন। এভাবেই ভেস্তে গেল সশস্ত্র বাহিনীর একাংশের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা। ১৮ জুলাই আঙ্কারার রাষ্ট্রপতি ভবনে বসে ধীরস্থিরভাবে উপরিউক্ত ঘটনাটি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ব্যক্ত করলেন যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএন টেলিভিশনের সাংবাদিক বেকি এন্ডারসনের কাছে, একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে। বললেন যে এই দেশদ্রোহিতায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের যথাযথ বিচার হবে। নিয়তির পরিহাস এই যে আন্তর্জাতিক টেলিভিশনগুলোর মধ্যে সিএনএনই এই অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা স্বীকার করতে অহেতুক সময় নিয়েছিল। সেই দিন আমরা টেলিভিশনের পর্দায় তা প্রত্যক্ষ করেছি।
নিরস্ত্র নাগরিকসহ এই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৬৫। আহত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। প্রায় ৯ হাজার সেনাসদস্য আর অন্য অভ্যুত্থান–সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেককে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তুরস্কে বর্তমানে মৃত্যুদণ্ড রহিত রয়েছে। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে তার পুনঃপ্রয়োগ চান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের সম্ভাবনা প্রবল। তবে তা যদি হয়, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহাল করতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বদ্ধপরিকর। এদিকে দেশে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন এরদোয়ান। প্রায় ৫০ হাজার সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত অথবা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এরদোয়ান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি দেশটির দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি এখন সেই দেশের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়াতে চাইছেন। চাইছেন দেশটির সাংবিধানিক রূপান্তরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালু করতে। দেশে-বিদেশে তাঁর সমালোচকেরা এরদোয়ানকে স্বৈরাচার বলে আখ্যায়িত করেন। এরদোয়ানের রাজনৈতিক দল একেপি আদর্শগতভাবে ইসলামঘেঁষা এবং তা নিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর একাংশের সঙ্গে এরদোয়ানের টানাপোড়েন রয়েছে। তবে তুরস্কের রাজনৈতিক বিরোধী দল এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সমালোচনা করেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেই দেশে স্বেচ্ছায় অবস্থানকারী ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছে। ফেতুল্লাহ গুলেন একসময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। এরদোয়ান তাঁকে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেরণা দেওয়ার জন্য দায়ী করছেন। ফেতুল্লাহ গুলেন একটি উদারপন্থী আন্তর্জাতিক সামাজিক আর ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা। কিন্তু তুরস্কের একেপি সরকার একে একটি সন্ত্রাসী সংস্থা বলে আখ্যায়িত করেছে। বলা হয়ে থাকে যে দেশটির বিচার বিভাগ আর পুলিশ বাহিনীতে এই আন্দোলনের অনেক সমর্থক রয়েছেন। এঁরা আন্দোলনকে ইসলামের ‘সালাফি’ মতবাদের বিকল্প হিসেবে দেখেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দলটির অনেক মতভেদ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই গোষ্ঠীকে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করেছেন, যদিও গুলেন এই অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছেন। বলেছেন, ‘সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গণতন্ত্র অর্জন করা যায় না।’ এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জন্য কারও কারও সন্দেহের তির যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই পড়েছে। ইংরেজিতে এই মর্মে একটি কথা আছে যে সাফল্যের জনক অনেকেই, কিন্তু ব্যর্থতা এতিম। কেউ কেউ এ–ও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন নেই। প্রেসিডেন্ট ওবামা আর জন কেরি এখন যা-ই বলেন না কেন, এই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ধোয়া তুলসীপাতা ছিল বলে মনে হয় না।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর সমর্থকদের বলেছেন, তাঁরা যেন একমাত্র আল্লাহর কাছে মাথা নত করেন। বলেছেন, অস্ত্রের মোকাবিলায় তাঁদের শক্তি ‘বিশ্বাস’। দেশটির হাজার হাজার মসজিদ এই সংকটে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পাশে দাঁড়িয়েছে। পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী। অতএব, দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই অপরিকল্পিত সমর্থনহীন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর আরও শক্তিশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এখন দেখার বিষয় যে এর মধ্য দিয়ে তিনি কি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি জাতীয় সমঝোতা অর্জন করার প্রচেষ্টা নেবেন, নাকি তিনি তাঁর এই নবলব্ধ অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁর স্বৈরাচারী অবস্থান দৃঢ়তর করবেন। এ–ও দেখার বিষয় যে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা কি কোনোভাবে দুর্বলতর হবে? বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের দমন করতে তিনি কি তুরস্কের সব মত ও পথের মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা পাবেন? তুরস্কের জন্য আগামীর দিনগুলো তাই গুরুত্বপূর্ণ।
তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহু শতাব্দীর। তুরস্কের সুফি সাধকেরা আমাদের চিন্তাচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কামাল আতাতুর্ক আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কামাল আতাতুর্ককে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই!’ রাজধানী ঢাকার একটি প্রধান সড়ক রয়েছে আতাতুর্কের নামে। ২০১০ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এরদোয়ান এবং ২০১২ সালে তুরস্ক সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বাইরে দুই দেশের মধ্যে শীর্ষপর্যায়ের অনেক সফর বিনিময় হয়েছে। তুরস্ক আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য গন্তব্য। আমাদের জাহাজনির্মাণশিল্পে তুর্কি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বাণিজ্য আর বিনিয়োগের ওপর আমাদের দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১২ সালে। আমাদের বাণিজ্যিক পরিমাণ সন্তোষজনক—বছরে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আমাদের বাণিজ্য আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ-তুরস্ক যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক দুই বছরে একবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
তবে হালে আমাদের দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে। তুরস্ক আমাদের কিছু যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি কামনা করে অনুরোধ পাঠিয়েছিল এবং মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর তারা ঢাকা থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছে। আমি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে ১৯৫৬ সাল থেকে ১৫ বছর কাজ করেছি এবং পাকিস্তান-তুরস্ক সম্পর্কের নিবিড়তা সম্বন্ধে আমার কিছুটা ধারণা তো আছেই। আমি আঁচ করছি, ভ্রান্ত হতেই পারে আমার ধারণা যে পাকিস্তান এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হিসেবেই তা প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের যুদ্ধাপরাধীরা প্রকাশ্য আদালতে বিচার পাচ্ছেন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যত্যয় থাকছে না। আমাদের যুদ্ধপরাধীদের বিচার হচ্ছে, কারণ যেকোনো অপরাধই বিচারের দাবি রাখে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর দেশের বিশ্বাসঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন দেশদ্রোহীদের শাস্তির আইনি বিধান পাল্টে। তা তিনি করছেন তাঁর দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য। অতএব, তিনি এখন বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা আশা করি বুঝবেন।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
[email protected]