২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যুদ্ধজয়ের পর আরও সমৃদ্ধিশালী ইউক্রেনের জন্ম হবে

সংঘাত শেষে শুধু অবকাঠামোগত পুনর্গঠনের জন্য ইউক্রেনের ১০০ বিলিয়ন ইউরোর প্রয়োজন হবেছবি : রয়টার্স

ভয়াবহ যুদ্ধের ১০০ দিন পেরিয়েছে। ইউক্রেনের নির্দোষ বেসামরিক জনগণের ওপর রাশিয়া এখনো বৃষ্টির মতো বোমা ফেলছে। এ অবস্থায় ইউক্রেন পুনর্গঠনের চিন্তা করা সত্যিই কঠিন। এরপরও সংকট আর বিপর্যয়ের এ দুঃসময়ে আমাদের ইউক্রেনের পুনর্গঠন নিয়ে ভাবতে হবে। ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য পশ্চিমা নেতৃত্বস্থানীয় দেশগুলোকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।

এ উদ্দেশ্য থেকে ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি ‘ইউক্রেন পুনর্গঠন’ নামে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে। ইউক্রেনকে যাতে ঋণসহায়তা ও মঞ্জুরি দেওয়া যায়, সে জন্যই এ প্রস্তাব। কিন্তু ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই নতুন অর্থায়নের উৎস খুঁজতে হবে। এ উৎস হতে পারে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থগিত করা বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অথবা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা এবং দেশটির অলিগার্কিদের বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তিও হতে পারে।

পুনর্গঠন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেন পুনর্গঠনের কাজটি হতে হবে ভূমিকম্প বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে ধরনের বিপর্যয় হয়, সেই আলোকেই। এ মুহূর্তের জরুরি করণীয় হচ্ছে, ইউক্রেনে রক্তপাত বন্ধ করা। এর অর্থ হচ্ছে, দনবাস, ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ থেকে দখলদার রাশিয়ান সেনাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। যত দিন গড়াচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইউক্রেনের প্রতিরোধযোদ্ধাদের (মাতৃভূমি প্রতিরক্ষা যোদ্ধা কিংবা সামরিক বাহিনী) বীরত্ব ও মানসিক দৃঢ়তা রয়েছে এ যুদ্ধজয়ের। দুর্ভাগ্যবশত, যুদ্ধের গতি পুরোটা নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সামরিক কিংবা মানবিক সহায়তা পায়নি ইউক্রেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি দিনে ইউক্রেন পুনর্গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা দিয়েছে, যেদিন মাউরিপোলের আজভস্টাল ইস্পাত কারখানা থেকে এক হাজার ইউক্রেনীয় সেনা হটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইউক্রেনের ধাতুশিল্প ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি ৮০ দিন ধরে আগলে রেখেছিলেন ওই সেনারা।

আমি আশা করি, ইউরোপ ও ন্যাটোর বন্ধুদেশগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও পুনর্গঠনে সমর্থন দেওয়া বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য জরুরি। রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করা এবং ইউক্রেন পুনর্গঠন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেনের জনগণ সেই চ্যালেঞ্জ অবশ্যই একা মোকাবিলা করবে না।

২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার নৃশংস হামলা শুরুর পর ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের যোদ্ধারা নিজেদের এক হাত পেছনে বেঁধে যুদ্ধ করছেন। অনেক মিত্রদেশ মুখে মুখে ইউক্রেনকে অনেক বড় সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। তারা রাশিয়াকেও দোষারোপ করেছিল, তা সত্ত্বেও ইউক্রেনের জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্রের জোগান তারা দেয়নি। অথবা এত ধীরে অস্ত্রের জোগান দিয়েছে যে সেটা চূড়ান্ত বিচারে অমার্জনীয় অপরাধ। ইউক্রেনীয়রা পুরো মহাদেশের মূল্যবোধ রক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়াকে রুখে দেওয়ার জন্য ইউরোপের হয়ে যুদ্ধ করছে। দুর্ভাগ্যবশত, ইউরোপের অনেক দেশ এমন আচরণ করছে, যেন তাদের নিরাপত্তায় কোনো হুমকির সৃষ্টি হয়নি।

আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেসব এলাকা মুক্ত করা গেছে (উত্তর কিয়েভের শহর ও গ্রামাঞ্চল), সেসব এলাকার বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ ও জীবনযাত্রা নতুন করে শুরুর তৎপরতা চলছে। পুনর্গঠনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ইউক্রেনের পক্ষে একা একা করা সম্ভব নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো সহযোগিতা আমাদের দিয়েছে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য সম্প্রতি তারা ৯ বিলিয়ন ইউরো অতিরিক্ত সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছে। এ জন্য আমরা ইউরোপীয় কমিশনকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এই যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, সংঘাত শেষে শুধু অবকাঠামোগত পুনর্গঠনের জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরোর প্রয়োজন হবে।

ইউক্রেন মুক্ত হওয়ার পর শিল্পাঞ্চল, বন্দর ও নগরগুলো পুনর্গঠনের প্রয়োজন হবে। যুদ্ধোত্তর ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য ‘মার্শাল প্ল্যান’ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপ পুনর্গঠনে আমেরিকার উদ্যোগ) ধরনের উদ্যোগ দরকার হবে। অর্থনীতি যাতে এক লাফে চালু করা যায়, সে জন্য প্রচুর নগদ সহায়তা দেওয়া, ইউক্রেনীয়দের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সেখানে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রাশিয়া ইউক্রেনকে যতটা ধ্বংস করেছে, ততটা পুনর্গঠন করলেই চলবে না, ইউক্রেনের পুনর্গঠন হতে হবে আরও সমৃদ্ধিশালী।
এই যুদ্ধে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা, বিপর্যয়ের ইতিহাস পেছনে ফেলে নতুন এক ইউক্রেন সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করেছে। সেটা হবে মুক্ত ও আধুনিক ইউরোপীয় ইউক্রেন।

এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই লড়ে ইউক্রেন প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর শক্তিশালী ও নির্ভরশীল সদস্য। ইউক্রেনীয়রা যখন তাঁদের দেশ পুনর্গঠন করবেন, ইউরোপীয় প্রকল্পের অংশীজন হিসেবেই তাঁরা সেই কর্মযজ্ঞে হাত দেবেন। একটি সহনশীল ও মুক্ত সমাজের আদর্শ হিসেবেই ইউক্রেন মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে। নিজেদের জনগণ ও মূল্যবোধ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ জাতি হিসেবেই ইউক্রেন টিকে থাকবে।

ইউক্রেন পুনর্গঠনের বিষয়টি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে, সেটা আমাদের সাহস জোগায়
ছবি : রয়টার্স

ইউক্রেন পুনর্গঠন কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে থাকবে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি। ইউরোপের মতো ইউক্রেনের ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা পরিসমাপ্তির ওপর। ইউক্রেন এরই মধ্যে ইউরোপের সঙ্গে নিজেদের বিদ্যুৎ-সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা একীভূত করার কাজ শুরু করেছে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ইউক্রেনের নীতিনির্ধারকদের দেশটির জ্বালানি অবকাঠামো ইউরোপীয় নেটওয়ার্কের যুক্ত করে নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি আমদানির নতুন উৎস খোঁজা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর ইচ্ছাও তাদের রয়েছে। ইউক্রেন সবুজ জ্বালানির নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন পুনর্গঠনের বিষয়টি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে, সেটা আমাদের সাহস জোগায়। ইউক্রেনের জন্য একটি মার্শাল প্ল্যান প্রণয়নের অঙ্গীকার করাই হবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নৃশংস আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার কার্যকর পদক্ষেপ। আমি আশা করি, ইউরোপ ও ন্যাটোর বন্ধুদেশগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও পুনর্গঠনে সমর্থন দেওয়া বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য জরুরি। রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করা এবং ইউক্রেন পুনর্গঠন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেনের জনগণ সেই চ্যালেঞ্জ অবশ্যই একা মোকাবিলা করবে না।

পল গ্রোড ইউক্রেনীয় ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে