আধুনিক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ‘ন্যায়ের’ ধারণা যৌক্তিক নয়। আফগানিস্তান ও ভ্যাটিকান—দুই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের পর তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অদ্ভুত রকম বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নয়-এগারোর হামলার শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত আফগানিস্তানের অর্থ ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে কানাডার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ভ্যাটিকানের ক্ষেত্রে খুব কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আফগানিস্তানে যখন লাখ লাখ মানুষ অনাহারে রয়েছে, তখন দেশটির সাড়ে তিন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কানাডার ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত আবাসিক স্কুলগুলোতে শত শত আদিবাসী শিশুর মৃত্যুর ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার পর ভ্যাটিকান শুধু প্রার্থনা ও ক্ষমা চাওয়ার মধ্যেই তাদের প্রায়শ্চিত্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আদালত নয়-এগারোর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আফগানিস্তানের অর্থ ব্যয় করার আদেশ দিয়েছে। তালেবানের অপরাধের বিরুদ্ধে দেওয়া এ আদেশ সম্মিলিতভাবে সব আফগান জনগণের বিরুদ্ধেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ‘সার্বভৌম অনাক্রম্য’-এর বলে বিদেশি রাষ্ট্রে বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে ভ্যাটিকান বাদ পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আইনি ব্যবস্থায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেটা কেবল কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ও সুনির্দিষ্ট কিছু শত্রুর বিরুদ্ধেই প্রয়োগ হয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যদি নিজেই সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হয় না। ঔপনিবেশিক সূচনার যুগে পশ্চিমারা নিজেদের বাইরের লোকদের বর্বর বা অসভ্য বলত। কোনো ধরনের সংযম না দেখিয়েই সেই বর্বর বা অসভ্য মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো হতো। আধুনিক যুগে সহিংসতা চালানোর জন্য ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
‘সন্ত্রাসবাদ’ থেকে মুক্ত হতে সুদান গত বছর যুক্তরাষ্ট্রকে ৩৩৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এর বিনিময়ে তাদের ‘সন্ত্রাসী’ রাষ্ট্রের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সুদানে আগ্রাসনের সময় দেশটির সবচেয়ে বড় ওষুধের কারখানা আল-শিফা ধ্বংস করে দিয়েছিল। সুদানের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ওষুধ ওই কারখানাটিতেই উৎপাদিত হতো। আল-কায়েদার ঘাঁটি বিবেচনা করে সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় আইনি প্রতিকার চেয়েছিল সুদান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আদালত অবৈধ ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন’ বলে সেটি খারিজ
করে দিয়েছিল।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য লিবিয়াকে দেড় বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালে লকারবিতে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এই ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। অন্যদিকে লিবিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় ৫৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। সেই পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণের জন্য যে মামলা করেছিল, সেটা ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘হঠকারী’ বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন মার্কিন আদালত।
মুসলমান এবং অন্যান্য ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত সন্ত্রাসবাদ’ যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অথচ আফগানিস্তান, ইয়েমেন অথবা বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করলে সেটা চাপা দেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক প্রভুরা বহু শতাব্দী ধরে ‘তাদের’ সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিয়েছে ‘বর্বরতা’র যুক্তি দিয়ে। কিন্তু ‘আমাদের’ পাল্টা সহিংসতাকে ‘তারা’ আবার ‘বর্বরতা’ বলে দায়ী করে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে ইরাকে আগ্রাসন চালায় ও অনুপ্রবেশ করে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের এ ঘটনায় তারা ইরাককে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। কিন্তু তারা ইরাক থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গিয়েছিল। কোনো মার্কিন নাগরিক ভবিষ্যতে দাবি করলে তাকে যাতে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা যায়, সে জন্যই তারা এ অর্থ নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে যাতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়, সে জন্য জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
অন্যদিকে মার্কিন সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের শিকার ইরাকি পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণের দাবি উপেক্ষিত থেকেই গেছে। অথচ ড্রোন হামলা, বাড়িঘর-স্থাপনায় বোমা হামলা, চেকপয়েন্টে গুলি চালিয়ে হত্যার মতো অপরাধ সেখানে মার্কিন সেনারা করেছেন। এমনকি আবু গারিব কারাগারসহ যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিভিন্ন কারাগারে ইরাক ও আফগানিস্তানের বন্দীদের ওপর জঘন্য নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। পেটানো, ছুরিকাঘাত, না খাইয়ে রাখা, বিদ্যুতের শক দেওয়া, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করা, নগ্ন করে রাখা, কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, উল্টো ঝুলিয়ে রাখা, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে নয়-এগারোর হামলায় বস্তুগত সহযোগিতার অভিযোগে কয়েক শ মিলিয়ন ডলারের যে ক্ষতিপূরণ মামলা করা হয়েছিল, সেটার রায় ইরাকের বিরুদ্ধেই গেছে। একই নীতিতে ইরানের বিরুদ্ধে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণের রায় দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ইরান আমেরিকার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
মুসলমান এবং অন্যান্য ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত সন্ত্রাসবাদ’ যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অথচ আফগানিস্তান, ইয়েমেন অথবা বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করলে সেটা চাপা দেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক প্রভুরা বহু শতাব্দী ধরে ‘তাদের’ সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিয়েছে ‘বর্বরতা’র যুক্তি দিয়ে। কিন্তু ‘আমাদের’ পাল্টা সহিংসতাকে ‘তারা’ আবার ‘বর্বরতা’ বলে দায়ী করে।
নৃবিজ্ঞানী তালাত আসাদের পর্যবেক্ষণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বর্বরতার (অথবা সন্ত্রাসবাদের) মূল বৈশিষ্ট্য এর দালিলিক তথ্যপ্রমাণের মধ্যে খুঁজলে চলবে না। এটা যে ভয়ের জগৎ তৈরি করে, সেখানেই নজর দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যুদ্ধ করতে গিয়ে ন্যায্য ও অ-ন্যায্যতার যে সূত্র প্রয়োগ করে, তার ভেতরে এর বৈশিষ্ট্য খোঁজা প্রয়োজন। প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের তুলনায় রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধনের ক্ষমতা অনেক বেশি। গত ২০ বছরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ১০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি নিহত হয়েছে। যুদ্ধের অপ্রত্যক্ষ ফলাফলে আরও বহুগুণ মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনূদিত
আজিজা কানজি টরন্টোভিত্তিক আইন বিশেষজ্ঞ ও লেখক