১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র এখন গভীর বিপদে। দেশে ও বিদেশে খুব আলগাভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত কয়েকটি ঘটনা বর্তমান এ সংকটের জন্য দায়ী।
বিদেশে চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একটি দমনমূলক শাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বের ওপর একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের ভেতরের যে শত্রু, তারাই গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এখন কট্টর ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি সুপ্রিম কোর্টে এই চরমপন্থীদের জন্য জায়গা করে দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টে চরমপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কি যোগ্যতার প্রদর্শন করলেন? ১৯৭৩ সালের ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার মাইলফলক রায়ে নারীরা গর্ভপাতের যে অধিকার পেয়ে আসছিলেন, সেটা বাতিল করে দিলেন। অবশ্য এটাই তাদের যোগ্যতার একমাত্র প্রমাণ নয়! তাঁরা তাদের সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা দিতে গিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং সেই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যতটা নিচে নেমেছেন, সেটাও তাদের বড় যোগ্যতা।
বিচারপতি স্যামুয়েল অ্যালিটো গর্ভপাতের অধিকার বাতিল করে দেওয়ার যে রায় সেটার বেশির ভাগ অংশের মতামত লিখেছেন। এই বিচারপতি দাবি করেছেন, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী কেবল সেই সব অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয়, যেগুলো ১৮৬৮ সালে এটি অনুমোদনের সময় বিদ্যমান ছিল। তাঁর এই যুক্তি ১৮৬৮ সালে চতুর্দশ সংশোধনী অনুমোদনের পর যেসব অধিকার নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা ভোগ করে আসছে, তার সব কটিকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এই যুক্তি ধরে এখন রাষ্ট্র আন্তবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিতে পারবে। ১৯৬৭ সালের আগে এ ধরনের বিবাহ নিষিদ্ধ করতে পারত রাষ্ট্র। আবার এ রায়ে এটা স্পষ্ট, আদালত নির্বাহী বিভাগের ওপর সরাসরি আঘাত করতে চায়। সম্প্রতি এর সবচেয়ে বড় নজির হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠিত অতি দরকারি কর্তৃপক্ষ এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির স্বীকৃতি দিতে রাজি হননি সুপ্রিম কোর্ট।
অবশ্য এই আইন যদি শুধু কারা ভোট দিতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করতেও প্রণয়ন করা হতো, সেটাও যথেষ্ট খারাপ একটা ঘটনা হতো। কিন্তু রিপাবলিকানরা এখন ভোট গণনা ও নির্বাচন–সত্যায়নের ব্যবস্থার ওপরও আঘাত করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সহজে ধ্বংস করে ফেলার জন্য আইনের পরিবর্তন ঘটাতে সেই ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁরা ট্রাম্পের সেই খোলা মিথ্যা কথায় (২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল চুরি করে নেওয়া হয়েছে) বিশ্বাস করেন। আমরা দেখছি যে রিপাবলিকানরা আমাদের গণতন্ত্রকে সব দিক থেকেই আক্রমণ শুরু করেছে।
সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমিই একমাত্র ব্যক্তি নই, যিনি বলছেন, আমেরিকান গণতন্ত্রের অস্তিত্ব গভীর বিপদে পড়েছে। গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা জেগে উঠেছেন। কিন্তু মানুষদের অবশ্যই বুঝতে হবে সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত কিসের অংশ। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি নিপীড়নমূলক শাসনের অধীন নিয়ে যেতে চায় তারা।
কট্টর রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে ধূমিধস বিজয় অর্জন করতে গেলে বিরোধীদের অনেক বড় বাধার মুখে পড়তে হবে। মুশকিল হলো, রিপাবলিকানরা শুধু সুপ্রিম কোর্টই দখল করেনি, অনেক নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্ট অতি সম্মানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্য দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানকে উঁচু থেকে নিচুতে নামিয়ে আনা হলো। গর্ভপাতের অধিকার হরণের রায়ে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতি সরাসরি বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের এ সিদ্ধান্ত আদালতের বৈধতাকেই ভূলুণ্ঠিত করে।’ দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টে ভিন্নমতালম্বী সংখ্যালঘুরা আরও দীর্ঘদিন ধরেই সংখ্যালঘু থেকে যাবেন। কেননা, চরমপন্থীরা বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং তাঁরা ৬–৩ ব্যবধানে সংখ্যাগুরু।
সুপ্রিম কোর্টকে রক্ষার একটা উপায় এখন খোলা আছে, সেটা হলো ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে রিপাবলিকানদের পরাজিত করা। সুপ্রিম কোর্টকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনসভার ওপর যে বৈধ অধিকার অর্পণ করা হয়েছে, সে জন্যই আজকের পরিস্থিতি। এটা এখন স্পষ্ট, এটা অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত। আইনসভাকে অবশ্যই এখন নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ জন্য যেসব বাধা আছে, প্রয়োজনে সেগুলো সংশোধন করতে হবে।
কট্টর রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে ধূমিধস বিজয় অর্জন করতে গেলে বিরোধীদের অনেক বড় বাধার মুখে পড়তে হবে। মুশকিল হলো, রিপাবলিকানরা শুধু সুপ্রিম কোর্টই দখল করেনি, অনেক নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, টেক্সাসের মতো অঙ্গরাজ্যে এমন একগুচ্ছ আইন তৈরি করা হয়েছে, যাতে ভোট দেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই আইনগুলো আফ্রিকান–আমেরিকানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং তরুণদের ভোটাধিকার খর্ব করার জন্য শুধু করা হয়নি, এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয় সুনিশ্চিত করা। ফ্লোরিডা আদালতের এক বিচারক সম্প্রতি এ ধরনের একটা আইন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ফ্লোরিডার নির্বাচনব্যবস্থাকে ভেঙে সাজাতেই এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য, যাতে নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের চেয়ে রিপাবলিকানরা বেশি সুবিধা পায়।’
এটা প্রতিরোধ করতে যা যা করার দরকার, তার সবকিছুই আমাদের করতে হবে। কিন্তু এটা শুধু ডেমোক্র্যাটদের বিষয় নয়। যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রাণ, সেটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
জর্জ সরোস, দ্য ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ার