কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা প্রথম দেখাতেই মনে দাগ কাটেন। আমার জন্য মোহাম্মদ আলী ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। আমার সাড়ে তিন দশকের কূটনৈতিক কর্মজীবনে এই পর্যায়ের যেসব বিরল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, প্রয়াত মোহাম্মদ আলী নিঃসন্দেহে তাঁদের প্রথম সারিতে। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর স্মৃতি আজ আমার স্মৃতিপটে চির উজ্জ্বল, চির অম্লান।
আমার সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর একবারই দেখা হয়েছে। তা ছিল দুবাই বিমানবন্দরে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮ সালে। আমি তখন আবুধাবিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমাকে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হলো যে মোহাম্মদ আলী সপরিবারে দুবাই হয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন এবং তাঁর অসাধারণ ক্রীড়াজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আমি তাই তাঁকে এবং তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যকে দুবাই বিমানবন্দরের ভিআইপি কামরায় সস্ত্রীক অভ্যর্থনা জানালাম।
মোহাম্মদ আলী ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে দুবাই বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। ভিআইপি কামরায় আমি ও আমার স্ত্রী অপেক্ষারত ছিলাম। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়াতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আরবি কায়দায় গালে চুমু দিয়ে বললেন, বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি অভিভূত। আমার স্ত্রী যখন তাঁর সহযাত্রী পিতাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে অভিবাদন করলেন, মোহাম্মদ আলীর পিতাও বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। তখন মোহান্মদ আলী বললেন, এটা ঠিক হলো না, এই সম্ভাষণের উত্তর হওয়া উচিত ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’। বললেন, সবার মনে রাখা উচিত যে বাংলাদেশ একটি সত্যিকার মুসলমানপ্রধান দেশ। আপনার ওপরে এবং সবার ওপরে শান্তি বর্ষিত হোক, এটাই তো কাম্য।
এ ঘটনা আমি আমার ২০১৪ সালে প্রকাশিত জীবনের বালুকাবেলায় বইটিতে উল্লেখ করেছি। দুবাই বিমানবন্দরে আমাদের সাক্ষাতের কয়েক মাস আগেই মোহাম্মদ আলী লিও স্পিংকসের কাছে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপে পরাজিত হয়েছেন। তিনি বললেন, তাঁর বয়স ৩৬ এবং স্পিংকসের বয়স হলো ২৪। তাঁর স্ট্র্যাটেজি ছিল প্রথম থেকে আক্রমণাত্মক না হয়ে স্পিংকসকে ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত করে ফেলা। বয়সের ব্যবধানের কারণে তা আর সম্ভব হলো না। পরেরবার স্পিংকসের সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধে তিনি তাঁর কৌশল পরিবর্তন করবেন। তিনি আমাকে বলেন, তাঁর শব্দের তালিকা থেকে ‘গ্রেটেস্ট’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ (গ্রেটেস্ট)। তিনি নিজে সর্বশ্রেষ্ঠ কেন, শ্রেষ্ঠও নন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্পিংকসই এখন ‘শ্রেষ্ঠ’!
মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সেদিনের প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা কথাবার্তা আমার এখনো কানে বাজে। ‘বাংলাদেশ একদিন দরিদ্র দেশ থাকবে না, যদি বাংলাদেশের মানুষ আত্মবিশ্বাস রাখে।’ বলেছিলেন মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
মোহাম্মদ আলী শুধু একজন মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বড় মাপের একজন মানুষ। তাঁর বিশ্বাসকে সর্বাবস্থায় তিনি সমুন্নত রেখেছেন, তাঁর জীবনে। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাই তিনি চার বছরের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৮ থেকে ৩২। একজন মুষ্টিযোদ্ধার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান একটি সময়। সেই চারটি বছর মুষ্টিযুদ্ধে থাকলে মোহাম্মদ আলীর অর্জন কোথায় যেত, কে জানে। তিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন নিয়েছিলেন দৃঢ় অবস্থান। তাঁর বিশ্বাস, তাঁকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল এই মানবতাবাদী। তাঁর ‘কেসিয়াস ক্লে’ নাম পাল্টে তিনি মোহাম্মদ আলী নাম গ্রহণ করলেন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা গ্রহণ করলেন ইসলাম ধর্ম।
তিনি নিজেকে ‘গ্রেটেস্ট’ না বললেও ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে বিবিসি পরিচালিত এক জনমত জরিপে বিংশ শতাব্দীর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব’ বলে নির্ধারিত হয়েছিলেন। এই জনজরিপে তাঁর সঙ্গে বিবেচনায় ছিলেন ফুটবলের পেলে, ক্রিকেটের ডন ব্রাডম্যান ও গলফের জ্যাক নিকোলস। কিন্তু বিবিসি জরিপের ভোটারদের মতে, মোহাম্মদ আলী ছিলেন এঁদের সবার ওপরে—‘সর্বশ্রেষ্ঠ’।
আমি মনে করি, মোহাম্মদ আলী সত্য ও ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাসী মানুষকে চিরদিন অনুপ্রাণিত করবেন। তাঁর অকালপ্রয়াণে আমি তাঁকে জানাই আমার গভীর বিনম্র শ্রদ্ধা।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।