মোটরসাইকেলটা কেন আত্মহত্যা করল

বারবার মামলা দেওয়ায় মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে নিজের রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করেন শওকত আলী (কালো পাঞ্জাবি পরা)
সংগৃহীত

মোটরসাইকেলটা কি আত্মহত্যা করল? পুলিশ তাকে চলতে বাধা দিয়েছে। একবার নয়, বারবার। বারবার বাধা পেয়ে তার প্রাণে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, তাতেই সে পুড়ে মারা গেছে। তার মাত্র দুটি চাকা। এই দুটি চাকা দিনমান শহরের অলিগলি, সড়ক-জটিলতায় ঘুরে বেড়ায়। ক্লান্তি লাগলেও ঘোরে। সকাল থেকে রাত কেবলই ঘোরে। চাকা দুটি ঘুরলে একটি পরিবার খেতে পারে। পরিবারের শিশুটিকে তখন ক্ষুধাপেটে ঘুমাতে যেতে হয় না। আরেকটু বড় শিশুটার স্কুলে যাওয়া চলতে পারে। শিশুদের মা–বাবাও তো মানুষ। তাদেরও খেতে হয় এবং মোটামুটি সভ্য মানুষ হয়ে সামাজিক নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। মোটরসাইকেলটি ছিল তাদের পারিবারিক ও সামাজিক মানুষ থাকার সহায়। এভাবে একটি পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরে ভারী আনন্দ হতো মোটরসাইকেলটির।

তার মালিকও তাকে খুবই কদর করত। তাকে রোজ পরিষ্কার করত। বাইরের লোককে দিয়ে ধোয়ালে অন্তত এক শ টাকা দিতে হয়। তাই মালিক নিজেই রোজ সকালে বাহনটির গা ধুইয়ে-মুছে চকচকে করে ফেলত। টাকাটা বেঁচে যেত। তারপর দুজনে একসঙ্গে পথে নামত। এখানে কে যে কার চালক বোঝা মুশকিল। বাইকটিকে চালকই চালান, কিন্তু চালকের জীবন চালায় ওই বাইক। বাইক না চললে যে খাওয়া জুটবে না! এভাবে দুজনে দুজনের হয়ে বিপদের দিন কোনোমতে পার করছিল।

তার মালিকের ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। ব্যবসার কাজে ঘোরাঘুরি আর মাঝেমধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেড়ানো, বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়া, স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, সবই হতো এই একটি বাইকে। কিন্তু করোনার বিধিনিষেধে লোকটির ব্যবসা মার খায়। তখন মোটরসাইকেলটি সহজেই রাজি হয়ে যায় মানুষ টানার ঘোড়ার জীবিকায়। তারা যাত্রী নিত, রাইড শেয়ার করত। তাতে করে গাড়ির তেল আর পরিবারটির জীবিকা, দুটোই আদায় হতো। করোনাকালে যাঁরা কাজ হারিয়ে পাঠাও বা উবারের চালক হয়েছেন, আমাদের এই শওকত তাঁদেরই একজন, ঘাটে ঘাটে মার খাওয়া অসহায় কর্মজীবীদের একজন।

কারণে-অকারণে পুলিশ ধরে। কাগজপত্র চায়। কাগজ ঠিক থাকলে রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমতি আছে কি না দেখতে চায়। যদি সব থাকেও, তখন কোন আইনের কোন জটিল ধারার প্যাঁচে আটকে কখনো মামলা দেয়, কখনোবা ঘুষ আদায় করে। কোনো কোনো মোড়ে আবার আজব-গজব হয়ে আসে ইজারাদের লোক। মোটরসাইকেল হোক বা হোক রিকশা কি সিএনজি, তাদের ১০-২০ বা ৫০ টাকা ফি দিতেই হয়। না দিয়েই–বা উপায় কী? ইজারাদারেরা যে ক্ষমতার বিদ্যুতে শক্তিশালী। তাদের না মানলে তারা হাই ভোল্টেজ শক খাইয়ে ছাড়বে।

সবই সহ্য হয়। কিন্তু বারবার মামলা দেওয়া, সেই মামলা ছোটাতে গাদাগাদা জরিমানা দেওয়া, তারপর আবারও মামলার ফাঁসে পড়া! মোটরসাইকেলটির আর সহ্য হলো না। সে তার গায়ে তেমনভাবেই আগুন ধরিয়ে দিল, যেভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন আরব বসন্তের সূচনাকারী হিসেবে বিবেচিত তিউনিসিয়ার সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি।

সবই সহ্য হয়। কিন্তু বারবার মামলা দেওয়া, সেই মামলা ছোটাতে গাদাগাদা জরিমানা দেওয়া, তারপর আবারও মামলার ফাঁসে পড়া! মোটরসাইকেলটির আর সহ্য হলো না। সে তার গায়ে তেমনভাবেই আগুন ধরিয়ে দিল, যেভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন আরব বসন্তের সূচনাকারী হিসেবে বিবেচিত তিউনিসিয়ার সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি। তিনিও পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

রাষ্ট্রের চোখ কিংবা সাংবাদিকের ক্যামেরা এই বাইরের আগুনটাই দেখে। কিন্তু দিনের পর দিন অপমান-নির্যাতন সইতে সইতে কড়া পড়ে যায় মনে। আত্মাটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে থাকে। যেমন খরায় শুকিয়ে যাওয়া পাতারা থাকে জ্বলবার জন্য প্রস্তুত, তেমনি দুর্দিনে বা দুঃশাসনে মানুষের মনও হয়ে উঠতে পারে দাহ্য। সামান্য স্ফুলিঙ্গ বা আঘাতেই সেখানে দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠতে পারে। কোনো ক্যামেরায় সেই আগুন ধরা পড়ে না, কোনো দমকল সেই আগুন নেভাতে পারে না। একমাত্র পারে সুবিচার, কিন্তু সেই বস্তুও বেঙ্গল টাইগারের মতো বিলুপ্তপ্রায়।

ঢাকা শহরে একজন বাইকচালকের মনে সেই আগুনই জ্বলেছে। পুলিশ মামলা দেওয়ার জন্য তাঁর গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে গেল। তিনি কাকুতি-মিনতি করলেন। কিছুতেই কাজ হলো না। শেষে তিনি প্রিয় মোটরসাইকেলটিতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশসহ সবার সামনে। এটা প্রায় আত্মহত্যামূলকই কাজ। গত বছর টাঙ্গাইলের এক কৃষক ধানের দাম নাই দেখে, ধান কাটানোর মজুরিও জোগাতে না পেরে রাগে-দুঃখে নিজের পাকা ধানের মাঠে আগুন লাগিয়ে দেন। কৃষকেরা প্রতিবছরই আলু কিংবা টমেটোর দাম নাই দেখে রাস্তায় ফেলে দেন যত্নে ফলানো শস্য। আর যেভাবে অভাবের জ্বালায় শিশুসন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয় কোনো কোনো মা, সেভাবেই জীবিকার উৎসকে পুড়িয়ে দিলেন শওকত সোহেল নামের এক যুবক।

শওকতের মতো অবস্থায় পড়া মানুষ প্রতিদিনই ঢাকার প্রায় প্রতিটি মোড়েই দেখি। ট্রাফিক সার্জেন্টরা হরহামেশাই মোটরসাইকেলওয়ালাদের থামান, প্রথমেই চাবিটা নিয়ে যান। তারপর যদি কাগজপত্র ষোলো আনা ঠিক থাকে, তাহলে হয়তো রক্ষা মেলে। কিন্তু মানুষকে ফাঁসানোর বাহানার কোনো অভাব কখনো পুলিশের হয় না। শওকত রাগে-দুঃখে নিজের একটি অংশকে হত্যা করেছেন। সেই অংশটি যদিও এক প্রাণহীন যন্ত্র, তবু সেটাই ছিল তাঁর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের প্রাণ টেকাবার সহায়।

বাংলা ভাষায় বিচিত্র কিছু শব্দজুটি আছে। ‘রাগে-দুঃখে’ তেমন এক। সাধারণত রাগ হয় অপরের প্রতি, দুঃখ হয় নিজের প্রতি। যখন অপরের প্রতি রাগের জবাব দেওয়া যায় না, প্রতিকার করা যায় না, তখন যে দুঃখের আগুন বুকে জ্বলে ওঠে, তাকে প্রকাশ করতে আমরা এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। রাগে-দুঃখে মানুষ নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে, নিজেকে কষ্ট দেয়। রাগ দেখাতে পারলে আর এই দুঃখ থাকত না।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ এমন রাগে-দুঃখে জর্জর অবস্থায় আছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতেও দেখা যায়, শওকত চিৎকার করছেন, ছোটাছুটি করছেন। এটা হতো না। হতো না যদি যারা ভালো আছে বলে মনে করছে, তারাও নির্যাতিতদের রাগ ও দুঃখের সঙ্গে শামিল হতো। সেই সহমর্মী জনতার অভাবেই একজন শওকত নিজের ক্ষতি করে আশাবাদ খেয়ে ফেলা অসহায়ত্বের বার্তাটা দিয়ে গেলেন।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]