ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছে ছিল, শাসনকালের প্রথম বর্ষপূর্তির আগেই চীন সফরে যাবেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ভারতে এসেছিলেন, নিজ রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরে সবরমতীর তীরে গান্ধী আশ্রমের দোলনায় দুলতে দুলতে তাঁকে সেই কথাই বলেছিলেন মোদি। বলার কারণও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে মাখামাখির পর তিনি যদি চীনে যেতে দেরি করেন, তাহলে সেই বিলম্বের নানান ব্যাখ্যা হতে পারে। মোদি তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছেন।
তিন দিনের চীন সফরে মোদি তিনটি শহরে থাকলেন। শিয়াং, যা কিনা চীনা প্রেসিডেন্টের আদি ভূমি, রাজধানী বেইজিং ও শিল্প-বাণিজ্যের ‘নার্ভ সেন্টার’ সাংহাই। প্রেসিডেন্ট শিকে মোদি স্বাগত জানিয়েছিলেন নিজ রাজ্য গুজরাটে, তারই প্রতিদানে শিয়াং গেলেন শিও, মোদিকে নিজ রাজ্যে স্বাগত জানাতে। প্রথা ভাঙার এই উদাহরণে মোদির মতোই পথিকৃৎ হয়ে থাকলেন চীনা প্রেসিডেন্ট। কূটনীতির একটা কঠিন বর্ম আছে। সেই বর্মেরই একটা অঙ্গ কূটনীতির নিজস্ব ভাষা, যার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বুঝে নিতে হয় কে কতটা কাছে এল বা কতটা দূরে দূরে থাকল। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই বর্ম শিথিল করার একটা চেষ্টা তাঁর মতো করে চালাচ্ছেন। অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ‘সেলফি’ তোলা অথবা ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে একান্ত বোঝাপড়ার চেষ্টা, মোদির ভাষায় কখনো যা ‘চায় পে চর্চা’, সেই সহজীকরণের একটা দিক। তিনি মনে করেন, পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতায় উত্তরণ ঘটাতে গেলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও জানাচেনা খুব জরুরি। তাই তিনি দোলনায় দোল খেতে খেতে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে চেয়েছেন অথবা হায়দরাবাদ হাউসের লনে নিজে হাতে করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পেয়ালায় চা ঢেলে দিয়েছেন কিংবা সীমান্ত বিল লোকসভায় পাস হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজে ফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। চীন সফরেও সম্পর্কের এই সহজায়ন ছিল তাঁর মননে। তাই কূটনীতির নিজস্ব আরোপিত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সত্য কথা সহজভাবে বলতে তিনি দ্বিধা করেননি। সেটা শেষ পর্যন্ত কতটা ফলদায়ী হবে, তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।
চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের দুটি দিক রয়েছে। একটি পুরোপুরি বাণিজ্যকেন্দ্রিক, অন্যটি দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিতর্ক। একদিকে দুই দেশের বিপুলায়তন, অন্যদিকে সীমান্ত বিতর্ক। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের ওপরই অবিশ্বাস ও সন্দেহের একটা চাদর বিছানো রয়েছে। মোদি এই সফরে সেই চাদর সরিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি দুজনের পক্ষেই সম্মানজনকভাবে বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তাই কোনো রকম রাখঢাক না করেই তিনি প্রকাশ্যে চীনা নেতৃত্বকে বলেছেন, সীমান্ত বিরোধের ন্যায্য ও সর্বজন যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান হওয়া জরুরি। একইভাবে তিনি প্রবল আপত্তি জানিয়েছেন, যেভাবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন অবকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করেছে অথবা অভিন্ন নদীগুলোর গতিপথ ও প্রবাহ বদলের চেষ্টা করছে। সহজ ভাষায় এত দৃঢ়ভাবে এসব কথা বলা ও যৌথ বিবৃতিতে তা উল্লেখ করতে গেলে একটা সাহসের প্রয়োজন হয়। সেই সাহস মোদি পেয়েছেন ভারতের বাজারকে চীনের সামনে হাট করে খোলার আগ্রহ দেখিয়েছেন বলেই। উদ্বৃত্ত অর্থের ভান্ডার নিয়ে বসে থাকা চীনও তাই ভারতের উদ্বেগ ও আপত্তির দিকটা খেয়ালে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। জমির দখল ও বাজার দখলের মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখার প্রয়োজনীয়তা তারা অস্বীকার করতে পারছে না।
ভারতের বাজারে চীন যত দখল নিচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে বাণিজ্য-ঘাটতি। মোদির কাছে সেটাও অন্য এক উদ্বেগ। বার্ষিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে চীন যা রপ্তানি করে, ভারত থেকে সেই তুলনায় আমদানি যৎকিঞ্চিৎ। ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ ও কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে চীনের বাজার প্রায় বন্ধ। এই বন্ধ দুয়ার খোলার প্রয়োজনীয়তা মোদি দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আমাদের বাজার যেমন খুলছি, তোমাদের বাজারও তেমন খুলতে হবে। বাণিজ্য-ঘাটতি না কমালে আখেরে তোমাদেরই ক্ষতি। দিল্লি থেকে চেন্নাই হাইস্পিড রেল করিডর খুলতে চীন তার আগ্রহ অনেক দিন ধরেই দেখাচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে চেন্নাই-বেঙ্গালুরু করিডরে দুই দেশ নীতিগতভাবে রাজি। চীন জানে, মোট ৩৬ বিলিয়ন ডলারের এই কাজ তাদের মুনাফাকেও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। কাজেই, সীমান্ত ও বাণিজ্য-ঘাটতির ভারতীয় উদ্বেগ উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে ক্ষতিকর। মোদিও প্রচ্ছন্নে সেই বার্তাই দিয়ে রেখেছেন।
চীন ও ভারত হাতে হাত মেলালে গোটা পৃথিবী যে তাদের সমীহ করতে বাধ্য হবে, এই বার্তা মোদি এবারের সফরে বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন। তা তিনি যেমন প্রেসিডেন্ট শিকে বলেছেন, তেমনি বলেছেন প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংকে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশেও তিনি ভারতের উদ্বেগ, চাহিদা এবং দুই দেশের মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনের দিকগুলো সরাসরি তুলে ধরেছেন। পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) ঢোকার জন্য চীনের সমর্থন যেমন খোলামেলা চেয়েছেন, তেমনি চেয়েছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদের জন্য সমর্থন। মোদি তারুণ্যে বিশ্বাসী। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে ভাষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে মোদি চেয়েছেন তরুণদের মনে ভারতের একটা ঝলমলে রঙিন ছবি এঁকে দিতে—অবিশ্বাস, সংঘাত ও সংশয়ের বদলে বিপুল সহযোগিতার অপার সম্ভাবনা যে ছবির ক্যানভাস।
ভারতকে চীন কখনো স্বাভাবিক মিত্র মনে করে না; বরং আগামী দিনের প্রতিদ্বন্দ্বীই ভাবে। চীনও সেই অর্থে ভারতের প্রিয় সখা নয়। ভারতকে চাপে রাখতে চীন তার সীমান্ত-হাতিয়ারের প্রয়োগ বারবার করে এসেছে। শির সফরের সময় চীনা ফৌজ ডেপসং উপত্যকার গভীরে ঢুকে দ্বিপক্ষীয় সংকটের সৃষ্টি করেছিল। এবারও মোদির সফরের আগে অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে তারা সরকারি বিবৃতি দিয়েছে। অথবা সফর চলাকালে চীনা টেলিভিশনে ভারতের বিকৃত ম্যাপ দেখিয়ে মোদিকে বিব্রত করেছে। সীমান্তের দাবি চীন যে ছাড়বে না, ভারতের তা জানাও। মোদি তাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) মতৈক্যের প্রশ্নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রয়োজনকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। চীনের লক্ষ্য যদি হয় ভারতের বাজার, মোদির হাতিয়ারও তাহলে সেটাই। ভারতের বাজারকে সামনে রেখে আধুনিক চীনা নেতৃত্বকে পাকাপাকিভাবে স্তিমিত করে উন্নয়নের রথের সওয়ারি হওয়াই মোদির পাখির চোখ। প্রেসিডেন্ট শির প্রতিশ্রুতি ছিল ২০ কোটি বিলিয়ন ডলারের লগ্নি। মোদির সফরে চুক্তির মোট পরিমাণ ২২ কোটি ডলার। ভারত না চীন, লাভের পাল্লা কার দিকে কতটা ঝোঁকে, ভবিষ্যতেই তা বোঝা যাবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।