মধ্যবিত্ত বাঙালি-জীবনে এই রকম একটা ছবি আমরা অনেক দেখেছি। স্বামীর ওপর রাগ করে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে এবং কিছুদিন কাটিয়ে আবার স্বামীর ঘর করতে এসেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকা এবং দৃঢ়চেতা না হওয়ায় গড়পড়তা বঙ্গ নারীর বাপের বাড়ি নামের তুরুপের তাসটা বেশি দিন বাজি জেতাতে পারে না। মানুষের জীবনে সম্পর্কের এই বিচিত্র ওঠানামা মোটেই বিরল নয়। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে এটাই আবার একমাত্র স্থিতিশীল। এবং সেই কারণেই স্বাভাবিক।
রাশিয়ার উফা শহরে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা ‘এসসিও’র আসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আরও একবার মোলাকাতের পর দুই দেশের সম্পর্ক ঘিরে বারবার মিলন ও বারবার বিচ্ছেদের এই উপমাই মনে পড়ল।
রাশিয়ার বাইরে উফা শহরটার নাম কজন জানতেন, তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। কিন্তু যেহেতু সেখানে দু-দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন (ব্রিকস ও এসসিও) হলো এবং সেই সম্মেলনের আসরে আরও একবার ভারত ও পাকিস্তানের মিলন ঘটল, উফা তাই বিশেষ পরিচিতি পেয়ে গেল। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরও (এখন উজবেকিস্তান) ঠিক এভাবে বিখ্যাত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান সন্ধি স্থাপন ও ঠিক তার পরের দিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আচমকা মৃত্যুর
কারণে। ভারত ও পাকিস্তানের মধুর ও তিক্ত সম্পর্কের ওঠানামার খতিয়ানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস এভাবেই ঘুরে ঘুরে আসে।
সম্মিলিত জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালের প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগী হয়েছিল। ১৯৬৫-র দ্বিতীয় যুদ্ধ বন্ধেও। কিন্তু দেশভাগ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ফলে যে অবিশ্বাস, অনাস্থা ও শত্রুতা দুই দেশে পাকাপাকি ঘাঁটি গাড়ে, তা দিন দিন বেড়েছে ছাড়া কমেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় যোগদান এবং পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ পাকিস্তান মানসিকতায় এক চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে রয়েছে। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। জেনারেল জিয়াউল হকের আমল থেকে কাশ্মীরে যে ছায়াযুদ্ধের শুরু, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সেটা এক নতুন বাঁক। সেই বাঁক ধরেই আজও এগিয়ে চলেছে সম্পর্কের স্রোত, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনাস্থাকে সঙ্গী করে। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে এটাই চিরন্তন সত্য।
>সম্পর্কে ওঠানামা থাকেই। কিন্তু তা তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠানামার অঙ্ক অথবা সাপ-লুডো খেলার মতো হওয়া উচিত নয়। নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের এই নতুন ইনিংস দীর্ঘস্থায়ী হলেই মঙ্গল
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকার নয়। চিরকালীন শত্রুতা নিয়ে ঘর যেমন করা যায় না, তেমনই প্রতিবেশীকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শত্রুতা সত্ত্বেও তাই বারবার হাত মেলানোর প্রচেষ্টা এই সম্পর্কে দেখা গেছে। ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি ঐতিহাসিক বাসযাত্রায় লাহোর গিয়েছেন। অথচ তার পরপরই ঘটে যায় কারগিল-কাণ্ড। এই নওয়াজ শরিফই সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তাঁরই নাকের ডগায় তাঁরই সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কারগিল ছকে ফেলে ক্রমেই তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করবেন, নওয়াজ শরিফ তা টের পাননি। কারগিল চুকেবুকে গেলে ফের সেই মিলনের উদ্যোগ। আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনে পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন। ২০০১ সাল। ব্যর্থ সফরের পর সেই বছরেরই ডিসেম্বরে আক্রান্ত হলো ভারতের সংসদ ভবন। ফের সেই অবিশ্বাস। ফের তিক্ততা। ফের সেই সন্দেহ ও শত্রুতার চোরাস্রোত। ২০০৮ সালের মুম্বাই আক্রমণ সম্পর্ককে আরও একবার তলানিতে নিয়ে আসে। আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের তাগিদে ভুটানের থিম্পুতে ২০১১ সালে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ঠিক হয়, দুই দেশই ইতিবাচক ও গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণরেখায় অবিরাম সংঘর্ষের ফলে দুই বছরের মধ্যেই তিতিবিরক্ত মনমোহন সিং জানিয়ে দেন, ‘দেয়ার কান্ট বি বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল উইথ পাকিস্তান’।
বলেছিলেন বটে, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে চিরকাল যে থাকা যায় না, সেই উপলব্ধিও ভারতীয় নেতৃত্বের ছিল। রাজনৈতিক পালাবদলের সময় নরেন্দ্র মোদি তাই সার্ক দেশের সবাইকে আমন্ত্রণ জানান ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণের সাক্ষী হতে। সম্পর্কের রকমফেরে সে ছিল এক দারুণ উদ্যোগ। তাঁর ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি যে স্রেফ চমকই নয়, তিনি যে সুসম্পর্ক স্থাপনে একান্তই আন্তরিক, তার প্রমাণও মোদি রাখতে চেয়েছিলেন বন্ধ থাকা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরুর মাধ্যমে। কিন্তু আবারও তার কেটে গেল। পররাষ্ট্রসচিবের ইসলামাবাদ সফরের ঠিক আগে সেই সফর বাতিল করে দেন মোদি নিজেই। কারণ, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়াত কনফারেন্স নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হাইকমিশনার আলোচনায় বসেছিলেন।
এত দূর এগিয়েও মোদি যে কেন হুরিয়াতকে খাঁড়া করে পিছিয়ে এলেন, তার সংগত কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। এমন নয় যে এর আগে পাকিস্তানের কোনো হাইকমিশনার হুরিয়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি। কতবার যে এ রকম কথাবার্তা হয়েছে, তা হয়তো গুনে শেষ করা যাবে না। পাকিস্তান অথবা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার অনুমতিও হুরিয়াত নেতাদের দেওয়া হয়েছে। তবু কেন সেই আচমকা সিদ্ধান্ত? আরও একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। গত এক বছরে পাকিস্তান এমন কিছুই কি করেছে, যাতে বন্ধ থাকা আলোচনা ফের শুরু করা যায়? হাফিজ সঈদকে শাস্তি দিতে পারেনি। লাকভিকেও না। কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ বন্ধ করে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঠেকাতে কুটোটি পর্যন্ত নাড়েনি। ভেঙে দেয়নি নিয়ন্ত্রণরেখার ওপাশের জঙ্গি ঘাঁটিগুলো। দাউদ ইব্রাহিমের টিকিও তারা আজ অবধি ছুঁতে পারেনি। সেই দাউদ, এক যুগ আগে পাকিস্তানের হাতে উপপ্রধানমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানির তুলে দেওয়া সন্ত্রাসী-তালিকায় প্রথম নামটি যার ছিল!
তাহলে? কেন ফের কথা বলার তাগিদ? কেনইবা উফায় আচমকা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার চমক? কেনই বা যৌথ ঘোষণাপত্রে বহু ঘোষিত ১০ দফা প্রস্তাবের নতুন উত্থাপন? কোন সিদ্ধান্তটি তাহলে ঠিক আর কোনটা ভুল? আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে ছয় মাস আগে কথা বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল ধরতে হবে। মজাটা হলো, এই নিয়ে এখন কারও মুখে কোনো কথা নেই।
সব দেশের মতো ভারতের রাষ্ট্রনীতিতেও কট্টর ও মধ্যপন্থীদের একটা সংঘাত আছে। নরেন্দ্র মোদি যে দলের নেতা, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেই বিজেপির নীতিও বরাবরই কট্টর। কিন্তু দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাতের পরিণতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ইসলামি মৌলবাদী শক্তি যখন দিন দিন বেড়ে চলেছে। সেই উপলব্ধি মোদির যে হঠাৎ আজ হলো, তেমন মনে করারও কোনো কারণ নেই। অতএব ধরে নেওয়া যায়, বাস্তববাদী মোদি আলোচনাকেই একমাত্র উপায় বলে ধরে নিয়েছেন। আলোচনা
বন্ধের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, এই পদক্ষেপ প্রকারান্তরে তারই স্বীকারোক্তি। এটা তাঁর বোধোদয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই, পাকিস্তানও সন্ত্রাসের শিকার। এটাও ঠিক, পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক কেউ একা নয়। সেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার রয়েছে। প্রবল পরাক্রান্ত সেনাবাহিনী আছে। স্বার্থান্বেষী গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই রয়েছে। আর রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী শক্তির প্রবল উপস্থিতি। এই চতুর্মুখী শক্তির মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হলে গণতন্ত্রী ভারতকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানি সরকারকেই বেছে নিতে হবে।
সম্পর্কে ওঠানামা থাকেই। কিন্তু তা তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠানামার অঙ্ক অথবা সাপ-লুডো খেলার মতো হওয়া উচিত নয়। নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের এই নতুন ইনিংস দীর্ঘস্থায়ী হলেই মঙ্গল।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।