নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। গত রোববার জাতীয় পার্টির নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কমিশন গঠন, আইন, সার্চ কমিটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সার্চ কমিটির জন্য তিনটি ও নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি নামও প্রস্তাব করেছেন। তারা নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে যার নাম প্রস্তাব করেছেন, তিনি অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় পার্টির সহাসচিব মুজিবুল হকের স্ত্রী।
এরপর পর্যায়ক্রমে নিবন্ধিত সব দলের সঙ্গেই রাষ্ট্রপতি কথা বলবেন। বিএনপি সার্চ কমিটি নিয়ে আহুত সংলাপের বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি, ২০২৩ সালের নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীন হতে হবে এবং নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তবে তারা এখনো স্পষ্ট করে বলেনি, রাষ্ট্রপতির সংলাপ বর্জন করবেন কি না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার বলেছেন, তাঁরা এখনো রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে কোনো আমন্ত্রণ পাননি। আমন্ত্রণ পেলে সিদ্ধান্ত নেবেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন কেন গঠন করা হয়? নির্বাচন করার জন্য। সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে: প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যে রূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিসয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগ করিবেন। সংবিধানে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই তা করেনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইন করতে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে এখন করার সময় নেই। ভবিষ্যতে আইন করা হবে।
বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি। ভারতে ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠন করে, যা নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি। কিন্তু আমাদের এখানে নির্বাহী বিভাগ কিংবা সার্চ কমিটির মাধ্যমে যেই পদ্ধতিতেই কমিশন গঠিত হোক না কেন, বিতর্ক চলছেই। আইন না হওয়া পর্যন্ত সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের ধারণা মন্দ নয়। এতে অন্তত কমিশন গঠন সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব ও আকাঙ্ক্ষা জানা যায়।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশন নিজেদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও পক্ষপাতিত্ব দিয়ে নিজেদের এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে কমিশনের প্রধান ও দলীয় কর্মীর মধ্যকার পার্থক্যটি উবে গেছে। নির্বাচন কমিশনের সব কাজের লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল নাগরিকের ভোটাধিকার রক্ষা করা এবং একটি সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হয়েছে সরকারের জন্য কমিশন, সরকারের কল্যাণে কমিশন।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি নির্বাচন কমিশন নিজেদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও পক্ষপাতিত্ব দিয়ে নিজেদের এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে কমিশনের প্রধান ও দলীয় কর্মীর মধ্যকার পার্থক্যটি উবে গেছে। নির্বাচন কমিশনের সব কাজের লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল নাগরিকের ভোটাধিকার রক্ষা করা এবং একটি সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হয়েছে সরকারের জন্য কমিশন, সরকারের কল্যাণে কমিশন। কমিশন স্বাধীন—এ কথা পদাধিকারীদের কাজে ও কথায় প্রমাণ করতে পারেননি, চেষ্টাও ছিল না।
কে এম নূরুল হুদা কমিশন গত পৌনে পাঁচ বছরে নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন মঞ্চস্থ করেছেন। তাঁদের কাছে ভোটার অগ্রাধিকার পাননি, অগ্রাধিকার পেয়েছে ক্ষমতাসীনদের মনস্তুষ্টি। তাঁরা কাউকে নির্বাচনী আইন মানতে বাধ্য করতে পারেননি, বরং যাঁরা আইন ভেঙেছেন, তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। সিইসি কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, বাংলাদেশে তাঁরা যে সুন্দর নির্বাচন করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রও করতে পারেনি। অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি যাই বলুন না কেন, এটি একেবারে খাঁটি কথা। আমেরিকায় হুদা কমিশনের মতো একটি নির্বাচন কমিশন থাকলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো ক্ষমতায় থাকতেন, জনগণ তাকে ভোট দিক আর না দিক।
হুদা কমিশনের ব্যর্থতার কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতারা এম এ সাদেক কমিশন ও এম এ আজিজ কমিশনের উদাহরণ টানেন। মাগুরা উপনির্বাচনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। মাগুরা উপনির্বাচনে জবরদস্তি করে জয়ী হতে গিয়ে বিএনপি নিজের সর্বনাশ করেছে। এখন তো ঘরে ঘরে মাগুরা হচ্ছে। অন্যদিকে এম এ সাদেক যে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিলেন, সেই সংসদের মেয়াদ ছিল ৯ দিন। আর এম এ আজিজ কমিশন নির্বাচনই করতে পারেনি; এরই মধ্যে ১/১১-এর পটপরিবর্তন ঘটল। কোনো মন্দ উদাহরণ দিয়ে আরেকটি মন্দ কাজকে জায়েজ করা যায় না।
নতুন নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে হবে, তাঁরা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার যে শপথ নেবেন, তাঁরা সেটি রক্ষা করতে পারবেন কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আসেনি। কিন্তু যেই বিদায়ী কমিশন নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে, নির্বাচনের আগেই তারা এমন পরিবেশ তৈরি করেছে, যাতে বিরোধী দলের প্রার্থী ও সমর্থকেরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন, সেই কমিশনকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। সংবিধান ভঙ্গের জন্য রাজনীতিকদের শাস্তি হয়, তাহলে সাংবিধানিক পদে আসীন অন্যদের কেন হবে না? জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার যে শপথ তাঁরা নিয়েছিলেন, তা পদে পদে ভঙ্গ করছেন; এখনো ভেঙে চলেছেন।
এ ছাড়া বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, প্রশিক্ষণের নামে অন্যায়ভাবে অর্থ নেওয়া, তিন-চার গুণ দামে ভোটিং মেশিন কেনার অভিযোগ আছে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিকার চাওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি কোনো ব্যবস্থা নেননি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও এর সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তাই বলে অভিযোগগুলো তামাদি হয়ে যায়নি।
রাজনীতিকেরা পাঁচ বছর পরপর জনগণের সামনে আসেন তাঁদের আমলনামা নিয়ে। তাঁরা কী করেছেন, কী করতে পারেননি, বিরোধী দল দেশবাসীর কাছে কী অঙ্গীকার করছে, সেসব বিচার-বিশ্লেষণ করে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেন। অতীতেও নিয়েছেন। কিন্তু কে এম কমিশন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে জনগণ তথা ভোটারদের বঞ্চিত করেছেন। এম এ আজিজ কমিশন এক কোটি ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করে রেহাই পাননি। কে এম হুদা সাহেব ১০ কোটি ভোটারের অধিকার নিয়ে জালিয়াতি করে জবাবদিহির বাইরে থাকবেন, তা হতে পারে না। তাই বলব, নতুন কমিশন গঠনের আগে পুরোনো কমিশনের আমলনামাটি একবার পরীক্ষা করে নিন।
দেশবাসী নিয়ম রক্ষার নির্বাচন যেমন চায় না, তেমনি হুদা কমিশনের মতো আরেকটি মেরুদণ্ডহীন কমিশনও দেখতে চায় না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]