মুরসি এবং মিসরীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি ভিন্ন পাঠ
কারাগারে আটক অবস্থায় মুরসির মৃত্যুর এক বছর পূর্তি হলো। এই মৃত্যুকে কার্যত হত্যাকাণ্ডও বলা যায়। পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশের পর প্রায় ছয় দশকের মধ্যে মুরসি ছিলেন ভোটে নির্বাচিত প্রথম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ভোটের এক বছরের মধ্যেই গণতন্ত্র আর মানবাধিকার রক্ষার নামে পশ্চিমের মদদে মিসরের সেনাবাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। মোটাদাগে মুরসি এবং তাঁর দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে ঘিরে দুইটি ধারা প্রচলিত।
মোটাদাগে পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বলা হয়, আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মুরসির ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনো অধিকার নেই। দ্বিতীয় পক্ষ, ধর্মীয় অনুশাসনকে পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিকাশ করে ক্ষমতা চর্চা করতে চায়। তাদের বক্তব্য ছিল, নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার দরুন সিসির সেনা অভ্যুত্থান অবৈধ। ইসলামপন্থী হিসেবেই তারা পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সহাবস্থান নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। হাজারো বই ছাপা হয়েছে, বড় বড় বিজ্ঞরা কথা বলেছেন। পশ্চিমা গণতন্ত্রের উদাহরণ আফগানিস্তান, কলম্বিয়া, ইরাক ও ভিয়েতনামে প্রদর্শিত হওয়ার পর গতানুগতিক এসব আলোচনায় মানুষ আগ্রহ হারিয়েছে। আগ্রহী পাঠকদের জন্য ওই গতানুগতিক আলাপ একপাশে রেখে কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে মিসরে পশ্চিমা মদদে উপনিবেশবাদবিরোধী গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে মজবুত এক দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে, তার একটি পঠন তুলে ধরতে চাই।
দীর্ঘ পশ্চিমা উপনিবেশবাদ প্রাচ্যের চিরাচরিত সমাজকাঠামো, চিন্তার শিকড় উপড়ে ফেলেছে। তাই প্রাচ্যের মানুষ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে প্রত্যক্ষ মুক্তির পরও উপনিবেশবাদের প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পার্থ চ্যাটার্জি থেকে আশিস নন্দী, সবাই উপনিবেশ ও উপনিবেশ–উত্তর এই সমাজকাঠামোর পরিবর্তন, যোজন–বিয়োজন নিয়ে কথা বলেছেন। মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পাশাপাশি উপনিবেশবাদ প্রাচ্যের সমাজে একধরনের পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ড রচনা করেছে, যার বেদবাক্য সবকিছুর শুরু পশ্চিম থেকে।
ফ্রানজ ফানোর ভাষায়, ঔপনিবেশিক শক্তি যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করায়, সেখানে শিশুদের শেখানো হয় ইউরোপীয়দের আগমন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রগতির সূচনাবিন্দু। এই সূত্র ধরেই মিসরীয় বাস্তবতায় উপনিবেশ–উত্তর রাজনৈতিক কাঠামোতে ‘সিভিল সোসাইটি’ এবং সেনাবাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিষ্ঠান। যারা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। সিভিল সোসাইটি গণমানুষের আগামী দিনের চিন্তার নির্মাণের পাশাপাশি গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষক বনে জাতীয়তাবাদের পরিধি অঙ্কনসহ শত্রু–মিত্রেরও অবয়ব নির্মাণ করে। সিভিল সোসাইটির অঙ্কিত শত্রুদের থেকে দেশরক্ষার নামে সেনাবাহিনী দেশের সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করে দেশের জনসাধারণকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নেন।
লক্ষণীয় যে উপনিবেশ–উত্তর জাতিরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো ধনপতিদের ভারে ন্যুব্জ। উপনিবেশ আমলের ধনাঢ্য শ্রেণি নতুন জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে সিভিল সোসাইটি ও সেনাবাহিনীর উচ্চ পদগুলো দখলে নিয়েছেন। তাই শারীরিকভাবে উপনিবেশবাদীরা বিদায় নিলেও তাদের নির্মিত কলকবজা বহাল তবিয়তে রয়েছে। অন্ততপক্ষে ফ্রানজ ফানন, জর্জীয় আগামবেনরা সেই কথাই বলছেন। তাই মিসরের রাজনীতিতে সিভিল সোসাইটি ও সেনাবাহিনীর ভূমিকার পাঠ ছাড়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন বোঝা অসম্ভব হতে পারে।
আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মার্কিনদের সঙ্গে মিসরের সেনাবাহিনীর দহরম মহরম দীর্ঘদিনের। একসময়ের মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী জামাল আবদেল নাসের আরব বিশ্বে সমাজবাদী চিন্তাচেতনার বীজ বপন এবং আরব জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করে মিসরকে পশ্চিমামুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তবে নাসের–পরবর্তী সময়ে সেই আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর শান্তির নামে মিসর মার্কিনদের দলে ভিড়ে যায়। ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিল যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মিসরীয় সেনাবাহিনীকে মার্কিনরা বার্ষিক প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সামরিক সাহায্যের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর সামরিক মহড়া ও মিসরীয় কর্মকর্তাদের মার্কিন মুলুকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তো ছিলই। সেনাবাহিনীর প্রতি মার্কিনদের এই আর্থিক ও আস্থার দরুন জন্মলগ্ন থেকেই মিসর শাসনকাঠামো জেনারেলদের মুঠোয়। তাই নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে সেনাবাহিনী মুরসিকে লাগাতার অপদস্ত করেছিল। নির্বাচিত সংসদকে বাতিলসহ মুরসির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি করে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরেছিল সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ছিল ওবামা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ।
এই সবকিছুর বর্ণনা উঠে এসেছে তৎকালীন নিউইয়র্ক টাইমসের কায়রো ব্যুরো চিফ ডেভিড ডি কার্কপ্যাট্রিকের ইনটু দ্য হ্যান্ডস অব দ্য সোলজার: ফ্রিডম অ্যান্ড কেওয়াস ইন ইজিপ্ট অ্যান্ড দ্য মিডল ইস্ট গ্রন্থে। সেনাবাহিনীর প্রতি পশ্চিমাদের এই অকুণ্ঠ সমর্থনে ভর করে নিয়োগকর্তা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জেলে পুরে ইউরোপ আমেরিকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন সিসি। পেয়েছেন লালগালিচা সংবর্ধনা। আদতে শুধু মিসরে নয়, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া এবং সমকালীন সুদানে সেনাবাহিনী পশ্চিমাদের বড় মিত্র। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে ফোন না করে সেনাপ্রধান আশফাক কায়ানিকে ফোন করেছিলেন ওবামা। এই থেকে প্রমাণ হয়, নির্বাচিত সরকার নয়, বরং সেনাবাহিনীকেই প্রতিপক্ষ ভাবে পশ্চিমারা। জাতীয়তাবাদ আর শত্রুর জুজু দেখিয়ে সেনাবাহিনীকে জনপ্রিয় করা হয়েছে। যে কাজে জড়িত ছিল সিভিল সোসাইটির একাংশ।
১৮৩৯ সালে আরব বিশ্বে আধুনিকায়ন শুরু হয়েছিল অটোমানদের সংস্কার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। তুর্কিরা যেভাবে ফ্রান্সের আধুনিকায়ন অনুসরণ করেছে, মিসরীয়রা ব্রিটিশদের অনুসরণ করেছে। ১৮৮২ সালে মিসরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরুর পর থেকে শিক্ষাসহ সব বিষয়ে ব্রিটিশদের অনুকরণ শুরু হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে টমাস মেকলের মাধ্যমে ভারতীয়দের রক্ত মাংসে ব্রিটিশ বানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনি মিসরেও ব্রিটিশ লর্ড ক্রোমার প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা বদল করে দিয়েছিলেন, যার বদৌলতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা মিসরে পাশ্চাত্য একটি শ্রেণি তৈরি করেছে, যারা আধুনিকতার নামে পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। নোবেলজয়ী ও সাবেক আন্তর্জাতিক আণবিক কমিশনের প্রধান এল বারাদি এবং আরব লিগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসা এই প্রজন্মের অন্যতম উদাহরণ।
নির্বাচন–পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে মুরসিকে সাত দশকের এই সিভিল সোসাইটিসহ রাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য কলকবজার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। সিভিল সোসাইটি রাজপথের দখল নিয়েছিল আর সেনাবাহিনীর অনুরোধে আদালত নির্বাচিত সংসদকে ভেঙে দিয়েছিল। সিভিল সোসাইটির একটি বিশাল অংশ আদালতের রায়কে মিসরে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসেবে অভিমত দিয়েছিলেন। অবাধ নির্বাচনে মুরসির কাছে হেরে যাওয়া এল বারাদি সিসির অভ্যুত্থানে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি সিসি যখন কায়রোয় দরবার হলে দাঁড়িয়ে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা ঘোষণা করছিলেন, তখন বারাদি সিসির ডান পাশে উপস্থিত ছিলেন। বারাদি এবং তাঁর পশ্চিমাঘেঁষা সিভিল সোসাইটি সিসির প্রতি আনুগত্যের ত্বরিত পুরস্কারও পেয়েছিলেন। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকারের সহকারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাদি এবং কয়েকজন সরকারের নানান প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হয়েছিলেন। সিসির সঙ্গে মতানৈক্যের দরুন বারাদি সরকার থেকে পদত্যাগ করলেও মিসরে গণতন্ত্র ফিরে আসেনি। হেনরি কিসিঞ্জার, কন্ডোলিৎসা রাইস ও কলিন পাওয়েলের মতোই পশ্চিমের নানা ফোরামে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক বক্তৃতা করে বেড়ান তিনি।
আরবসহ অ-ইউরোপীয় দেশগুলো যখনই পশ্চিমাদের অঙ্কিত রূপরেখার বাইরে গিয়ে নিজস্ব নীতি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে, তখনি পশ্চিমারা সিভিল সোসাইটি ও সেনাবাহিনীকে ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন। যার দরুন বারবার পরাজিত হয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। নব্য উপনিবেশবাদের কাঠি হিসেবে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে আসছে পশ্চিমারা। মোহাম্মদ বিন সালমান অথবা কাতার এবং আরব আমিরাতের আমিরদের নির্বাচনের দরকার হয় না। কিন্তু মুরসিরা গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হলেও তাঁদের গণতন্ত্রী হয়ে ওঠা হয় না, কারণ তাঁরা মার্কিনদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সঙ্গী নন, কিংবা অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সমর্থক নন।
সমালোচকেরা বলেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্যই মুরসিকে উৎখাত করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, সিসির অধীনে প্রায় দুই হাজার মানুষ উধাও হয়ে গিয়েছে। হাযেম আজিম, ওয়ায়েল আব্বাস ও আমাল ফাতেহের মতো প্রসিদ্ধ সমাজকর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। রাজনৈতিক ভিন্নতার দরুন সামাজিক দমননীতি বেড়েছে। পাঠক স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতে পারেন, মুরসি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে কি রাজনৈতিক নিপীড়ন এড়ানো যেত! এই প্রশ্নের কোনো সাদাকালো উত্তর নেই। তবে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন–সংগ্রাম করে অধিকার আদায় করা সম্ভব হয়, যা মুসোলিনি কিংবা সিসিদের বিরুদ্ধে করা অসম্ভব।
রাহুল আনজুম: গবেষক