সেদিন ছুটির দিনে কারওয়ান বাজারের সামনে একটি নাতিদীর্ঘ পথনাটকের অভিনয় হচ্ছিল। মান্নান হীরা রচিত নাটকের নাম চন্দ্রমুখী। আশপাশের লোকজনের আগমনে বেশ দর্শক জুটে গেল। চারদিকের হইহুল্লোড়ের মধ্যেও নাটকটি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো।
নাটকের সমাপ্তি ঘটল শিশু চন্দ্রমুখীর মৃত্যুতে। ফলে ভেজাল মেশানোর বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করল চন্দ্রমুখী। দর্শকেরা সজল আঁখি নিয়ে যার যার গন্তব্যে চলে গেল।
বহু শতাব্দী আগে ভাস রচিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে রাক্ষস ছিল একটি ইতিবাচক চরিত্র। মানুষ চাণক্য ছিল মানবজাতির জন্য নেতিবাচক। কিন্তু ভাস রাক্ষস আর মুদ্রার সঙ্গে একটা যোগসূত্র সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। মানুষ কালক্রমে নানা দিক থেকেই রাক্ষসের চরিত্র অর্জন করেছে। সেও মানুষের গন্ধ পায়, মানুষের অস্থিমজ্জা উদরস্থ করে। লাখ-কোটি মানুষকে হত্যা করে ধ্বংসযজ্ঞে প্রেত-নৃত্যের আয়োজন করে। আরেক ধরনের মানুষ সত্যি সত্যিই মুদ্রারাক্ষসে পরিণত হয়েছে।
মুদ্রা চাই, মুদ্রা
হাউ মাউ খাউ,
মুদ্রার গন্ধ পাই।
এই মুদ্রার জন্য কিছু মানুষ ক্ষমতা অপব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয় না, নিজের বুদ্ধি ব্যয় করে, অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করে অর্জন করে রাশি রাশি মুদ্রা। এ পৃথিবীর সর্বত্র। চেরনোবিল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে লাখ লাখ শিশু। সেই ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তাদুষ্ট সেই সব খাদ্যদ্রব্য তৃতীয় বিশ্বেও ঢুকে পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের দেশে খাদ্যের বিষয়ে কঠিন কঠিন আইন রচনা করেছে। আবার সেগুলোর কঠোর বাস্তবায়নও হচ্ছে। আমাদের দেশে এত দিন পর ফরমালিন রোধে আইন হয়েছে বটে কিন্তু এর চেয়েও আরও ভয়াবহ সব কেমিক্যাল খাদ্যে মেশানো হচ্ছে। আমাদের অজান্তেই যেমন অনেক কিছু ঘটে যায়, হেফাজতের মতো একটা শক্তির উত্থান হঠাৎ দেখতে পাই, তেমনি মনে হয় প্রায় পুরো খাদ্যজাত দ্রব্যই এখন ভেজালের আওতায় চলে গেছে।
সম্প্রতি ঢাকার পুলিশ কমিশনার সত্যি কথাই বলেছেন, আইন দিয়ে খাদ্যের বিষক্রিয়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এ অসম্ভব। কারণ, এর পেছনে আছে নানা ধরনের মুদ্রারাক্ষস। কেউ আছে রাষ্ট্রক্ষমতার মধ্যে, কেউ আছে সরকারের মধ্যে, আর মহামুদ্রা রাÿস ব্যবসায়ী কুল। এখানে কৃষক মুদ্রারাসের বলি। ক্রমে সে কৃষি ছেড়ে শহরে রিকশাচালক হয়েছে। অস্থিচর্মসার তার অবস্থা। কিন্তু রাস বাহাদুর মুদ্রা খেয়েই চলেছে। মানবতাবর্জিত মুদ্রার শক্তিও অসীম। মুদ্রার জয়গান চলেছে অনাদিকাল থেকেই। যার হাতে মুদ্রা, তার হাতে ক্ষমতা।
কিন্তু খাদ্য যেহেতু মানুষের জৈবিক অধিকার, তাই মানুষ চিরকাল কৃষিকে পূজা করে এসেছে। তাই একটি ক্ষেত্রকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। বড় বড় কৃষি খামারের মালিকেরাও এ ক্ষেত্রে সচেতন থেকেছেন। গ্রিক পুরাণ ও ভারতীয় পুরাণেও খরা, মঙ্গার সঙ্গে অভিশাপ বা রাজার কুকীর্তির কথা বলা আছে। এসব সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। মানুষের ক্ষেত্রেও ভীমরতি ঘটেছে। সহজলভ্য মুদ্রা মানুষকে মুদ্রারাক্ষসে পরিণত করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশাতে পারলে কয়েক গুণ লাভবান হওয়া যায়। দুধে পানি মেশানো হতো কিন্তু এখন দুধে ফরমালিনও দেওয়া হচ্ছে। ফরমালিন মেশানো দুধ খেয়ে শিশুর কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। টেস্টিং সল্ট উন্নত বিশ্বে এমনকি চীন দেশে যেখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতো, সেখানেও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশে শিশুদের প্রিয় খাবারগুলোতে তা রয়ে গেছে বিপুল পরিমাণে। চিপস, চানাচুর ইত্যাদি মুখরোচক খাবারে তা বহাল তবিয়তেই আছে।
শিশুকালে প্রাকৃতিক খাবারের ফলে যে মানবদেহটি তৈরি হয় তা কালক্রমে মেধা ও মননে বিকশিত হতে থাকে। এই বয়সটায় যদি সে ভেজাল দুধ খেতে শুরু করে সর্বপ্রকার তেজস্ক্রিয় খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে অকাল বার্ধক্য ও নানা অসুখে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হৃদ্রোগ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
মুদ্রারাক্ষসেরা যে শুধু ঠিকাদারি ব্যবসায়ই দুর্নীতি করছে, তা না, সনাতনী ব্যবসা যেমন: ভূমিদস্যুতা, নিয়োগ-বাণিজ্য সর্বত্র তাদের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে খাদ্যে ভেজাল বাণিজ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য পরিবহন সব জায়গাই মুদ্রারাক্ষসদের হাতে। প্রতিদিনই কোটি কোটি মুদ্রা উদরস্থ করছে তারা। রাক্ষসও অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণে একসময় অবশ বা ক্লান্ত হয়ে যায় কিন্তু আমাদের মুদ্রারাক্ষসেরা ক্লান্ত হয় না, অবশ হয় না। শিশু চন্দ্রমুখী হত্যায় তার কোনো অনুশোচনা নেই।
পুলিশ কমিশনার উদ্যোগ নিয়ে গাবতলীতে একবার লক্ষাধিক আম বাজেয়াপ্ত করলেন। তাতেই বা কী লাভ? লাভ হয়তো হয়েছে, অনেক লোকই এ বছর আম খায়নি। আম এ দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ফল। নির্দিষ্ট ফলের সময় ওই সময়ের অনেক রোগের প্রতিষেধক থাকে। আবার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ওষুধ, প্রসাধনী ও টিনজাত খাবারের ব্যবহারেও প্রাণহানি হচ্ছে। একবার অনেক শিশু একসঙ্গে ভেজাল প্যারাসিটামল খাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেছিল। কিছুদিন আগে তার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মাত্র সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি একবার থাইল্যান্ডের এক দ্বীপে হোটেলে অবস্থান করছিলাম। হোটেলটি সমুদ্রের ওপর। একদিন সকালে নাশতা পরিবেশনে বিলম্ব হচ্ছিল। ক্ষুধার্ত হয়ে কিচেনের কাছে এসে দেখি কিচেনকর্মী অনেকগুলো রুটি নিচে সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, রুটি পানিতে ফেলে দিচ্ছ আর আমরা ক্ষুধায় অতিষ্ঠ। তখন ওই কর্মীটি জানালেন, এগুলোর মেয়াদ গতকালই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন রুটি আসছে। ততক্ষণ অপেক্ষা করুন। কর্মীটি খুব শিক্ষিত নন কিন্তু এই দায়টুকু তঁার আছে যে গতকালের বাসি হয়ে যাওয়া রুটি কিছুতেই খেতে দেওয়া যাবে না। তাতে যদি হোটেলের অতিথি বিরক্ত হয় তবুও। আমাদের দেশে পণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখের কোনো বালাই আদৌ আছে কি?
পুলিশ কমিশনার ঠিকই বলেছেন, আইন রক্ষাকারী সংস্থা কোনো অবস্থাতেই এই দায়বদ্ধতা শেখাতে পারবে না। তবে দোষী ব্যক্তিরা যাতে শাস্তি পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। সেটিও কি সব সময় পারবে? পেছনে যখন বড় বড় মুদ্রারাক্ষস পাহারা দিচ্ছে। নাটকটি যখন হচ্ছিল তখন পেছনে একটি ব্যানার শোভা পাচ্ছিল, ‘নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন’। জানলাম, কিছু নাট্যকর্মী ও প্রকৌশলী এই আন্দোলন গড়ে তুলতে চান। তাঁদের একটি লিফলেটও বিতরণ করা হচ্ছিল। বক্তব্য একটাই, প্রজন্ম বাঁচান। আমরা সবকিছুর জন্যই সরকারকে দায়ী করি, সবই সরকারের কর্তব্য বলে মনে করি। ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায় তাতে লাঘব হয়ে যায়। অবশ্য সরকারও সবকিছুর দায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। কারণ, সে সমাজকে শাসন করতে চায়। আইন তার হাতে। তাই সামাজিক আন্দোলনগুলোকেও সে বাড়তে দেয় না। এসব মুদ্রারাক্ষস চিহ্নিত হলে তার মধ্যে তার লোকও তো থাকবে। সরকারের মধ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও দায় নেই, একমাত্র দায় সরকারপ্রধানের। তিনি যতটুকু দায় নেবেন ততটুকুই হবে।
ওয়াসা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার জন্য দায়বদ্ধ। ওয়াসা তার পাইপলাইন নিয়ে নিজেই বিব্রত ও আস্থাবান নয়। তাই সে খাবার পানি হিসেবে ‘শান্তি’ (বোতলজাত খাবার পানি) বিক্রি করছে। পানির ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে নাগরিকেরা বাড়তি পয়সা খরচ করে পানি পরিশোধনযন্ত্র ব্যবহার করছে। পশ্চিমা বিশ্বে ট্যাপের পানি অবলীলায় মানুষ পান করছে। আমদানি করা এসব যন্ত্রের ফলে আরেক ধরনের মুদ্রারাক্ষস তৈরি হচ্ছে।
মুদ্রারাক্ষসেরা খুবই সুরক্ষিত। তাদের বিনাশ প্রচলিত আইনে বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অসম্ভব। এ যেন কিশোরগঞ্জের লোককাহিনি মাধব মালঞ্চী কইন্যার সেই রাক্ষস, যে রাক্ষসকে কেউ পরাজিত করতে পারে না। রাজা, সেনাপতি, পাইক, বরকন্দাজ কেউ না। শেষে মালঞ্চী কইন্যা আবিষ্কার করল রাক্ষসের প্রাণভোমরা হাতে, পায়ে, মাথায়, হৃৎপিণ্ডে কোথাও নেই, আছে কানে। কানটা কেটে ফেললেই রাক্ষসের বিনাশ হবে। অতঃপর রাক্ষসের কানটা কেটে ফেললেই রাক্ষস ভূপাতিত হলো।
আমাদের মুদ্রারাক্ষসের কানটা কোথায়? সেই সন্ধান কে জানে? আমরা সবাই জানি। কান টানলে মাথা আসে। রাক্ষসের কান টানলে যে মাথাগুলো আসে তা আমরা সবাই জানি। তাই বসে থাকার উপায় নেই, সবাই মিলে মুদ্রারাক্ষসটাকে ধরে ফেলি।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।