পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বছরের ২৭ মে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দুটি যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। প্রথমটি পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের। পশ্চিমবঙ্গ, ইংরেজিতে যা ওয়েস্ট বেঙ্গল—মমতার মনঃপূত হচ্ছিল না। কারণ, বিশাল ভারতের ৩৬টি রাজ্য আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একেবারে নিচে ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম। ওয়েস্ট বেঙ্গলের শুরু ‘ডব্লিউ’ দিয়ে। ফলে রাজধানী দিল্লি বা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নানা বৈঠকে এই ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম থাকে সব শেষে। এতেই আপত্তি ছিল মমতার। তাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একচ্ছত্র দখল তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের। ২৯৪ আসনের ২১১টিই এখন তাঁর দলের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ আসন হওয়ায় কোনো বিল বিধানসভায় পাস করানো মমতার পক্ষে কঠিন নয়। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মমতা প্রথম যুদ্ধে নামেন।
২ আগস্ট তিনি তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রথমে পাস করে নেন পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের। প্রস্তাব পাস করেন দুটি নামের। বঙ্গ ও বাংলা। পরে অবশ্য মমতা ঠিক করেন বঙ্গ নয়, নাম হবে বাংলা। ২৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাস করিয়ে নেন বাংলা নাম। এখন এই নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব চলে গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিলটি পাস হলে যাবে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায়। সেখানে পাস হলে যাবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সংবিধান সংশোধন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন হয়ে যাবে বাংলা। তবে কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আগেই মমতার মন্ত্রীরা পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা বলতে শুরু করেছেন। ফলে প্রথম যুদ্ধে জিতে গেলেন মমতা।
>ওয়েস্ট বেঙ্গলের শুরু ‘ডব্লিউ’ দিয়ে। ফলে রাজধানী দিল্লি বা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নানা বৈঠকে এই ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম থাকে সব শেষে। এতেই আপত্তি ছিল মমতার
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এই নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও এই রাজ্যের নাম বাংলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের মে মাসে প্রথম পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসার পর মমতা আগস্ট মাসে এক সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। তখন সেখানেই উঠে আসে ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম ইংরেজিতে পশ্চিমবঙ্গ লেখা হোক। নামের আদ্যক্ষর ‘পি’ থাকায় রাজ্যের নাম কিছুটা ওপরে চলে আসবে। বৈঠকে এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর তা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য। ২০১৪ সালে কেন্দ্র-রাজ্যবিষয়ক তৎকালীন যুগ্ম সচিব সুরেশ কুমার জানিয়ে দেন, সংবিধান সংশোধন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংসদে আনা হবে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল (অল্টারেশন অব নেম) অ্যাক্ট ২০১৪’ নামের একটি সংশোধনী বিল। কিন্তু সংসদে আর আসেনি সেই বিল। এর আগেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাম পরিবর্তন হয়েছে। মাদ্রাজের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে তামিলনাড়ু, হায়দরাবাদের পরিবর্তে হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্য ভারতের নাম হয়েছে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চলের পরিবর্তে হয়েছে উত্তরাখন্ড, উড়িষ্যার পরিবর্তে হয়েছে ওডিশা ও মহীশূরের পরিবর্তে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্য।
মমতার দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে। তখন পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সিঙ্গুরে টাটাদের একলাখি ন্যানো গাড়ির একটি কারখানা গড়ার জন্য বামফ্রন্ট সরকার ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা টাটাকে লিজ দিয়েছিল। এই অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন সিঙ্গুরের অন্তত ৪০০ একর জমির মালিক কৃষকেরা। তাঁরা জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। পাশে পেয়ে যান তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মমতা শুরু করেন সিঙ্গুর আন্দোলন, জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন। তিনি সিঙ্গুরে টানা ২৬ দিন অনশন আন্দোলনও করেন। তৎকালীন টাটার কর্ণধার রতন টাটা এই আন্দোলনের মুখে পড়ে ঘোষণা দেন, তাঁরা আর সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ির কারখানা বানাবেন না। এই কারখানাকে নিয়ে যান গুজরাটের সানন্দে। প্রাথমিকভাবে জিতে যান মমতা। আসে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন। বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসেন মমতা। ক্ষমতায় বসেই সিঙ্গুরের সেই অনিচ্ছুক কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নেন তিনি। শুরু হয় আইনি জটিলতা। বিরোধ শুরু হয় টাটাদের সঙ্গে। মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাইকোর্টে। এখানে টাটাদের পক্ষে রায় গেলেও এই মামলা নিয়ে আপিল হয় ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। দীর্ঘ ১০ বছর পর সেই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হয় ৩১ আগস্ট। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেন, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ ছিল অবৈধ। দ্বিতীয় যুদ্ধে জিতে যান মমতা। পশ্চিমবঙ্গের শক্তির একক আধার হয়ে ওঠেন মমতা। এখন তিনি সিঙ্গুরের সেই ৯৯৭ একর জমি কৃষকদের হাতে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
এই দুটি যুদ্ধজয় মমতাকে এবার নতুন এক দিকনির্দেশনা দিলেও পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। নাম পরিবর্তনের বিল সংসদে তুলে তা পাস করালেই পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যাবে বাংলা। মুছে যাবে পশ্চিমবঙ্গ নামটি। কিন্তু নাম পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা সাড়া দেবে—রাজনৈতিক মহলে সেই প্রশ্নটি এখন উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্ব এখনো এই নামের বিরোধিতায় আছে। তারা বারবার বলছে, এভাবে নাম পরিবর্তন কেন? প্রয়োজনে এই নাম নিয়ে গণভোট নেওয়া হোক। তাই কেন্দ্রীয় সরকার এই নাম পরিবর্তনের জন্য কতটা যত্নবান হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তবু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এমনটা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবে সায় দিয়ে সংসদে নাম পরিবর্তনের বিল এনে তা পাস করিয়ে দিতে পারে মোদি সরকার। কারণ, আগামী ২০১৯ সালে ভারতের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে যে মমতা বিপুল ভোটে জিতবেন, সেটা বিজেপির কাছে স্পষ্ট। বিজেপি চাইবে না, দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ক্ষমতা ছাড়তে। তাদের জিততে হবে মোদিকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী বানাতে।
সুতরাং, পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন বিল পাস ও অন্যান্য কারণে মমতাকে মোদির প্রয়োজন হবে। এই অঙ্ক কষেই বিজেপির নেতারা চাইবেন না মমতাকে চটাতে। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে মোদি সরকার মমতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য শেষ পর্যন্ত পাস করিয়ে দিতে পারে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের সংবিধান সংশোধনী বিল।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।