দিলশাদ আরা (ছদ্মনাম) একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় উচ্চ পদে কাজ করেন। কিছুদিন আগে তিনি একজন নারী সহকর্মীসহ এক উচ্চপদস্থ পুরুষ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানটির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আমন্ত্রণপত্র সরকারি কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে সহকর্মীসহ বিদায় নেওয়ার কথা বলতেই সরকারি কর্মকর্তা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন? আপনারা নারীরা হলেন সৌন্দর্যের প্রতীক। আপনারা পাশে থাকলে আমরা কাজে উৎসাহ পাই।’
দায়িত্বশীল পদে আসীন সরকারি কর্মকর্তার হঠাৎ এই রকম উক্তি শুনে ভীষণ বিব্রত বোধ করলেন দিলশাদ আরা। তাঁর বিব্রত হওয়া মুখটি হয়তো প্রত্যক্ষ করেছিলেন কর্মকর্তা। এরপর বললেন, ‘আমাকে আবার মুরাদ হাসান ভাববেন না যেন। এত মাপজোখ করে কি কথা বলা যায় ম্যাডাম? জীবনে তো তাহলে আনন্দ-ফুর্তি বলে কিছুই থাকবে না।’
দিলশাদ আরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি কী করবেন। তিনি কি প্রতিবাদ জানাবেন? কীভাবে প্রতিবাদ জানাবেন? এই প্রতিবাদের পরিণতিই-বা কী হবে? এই প্রতিবাদের জেরে হয়তো বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তাঁর সংস্থাটির, তাঁর চরিত্র নিয়েও হয়তো টানাহেঁচড়া করবেন কেউ কেউ। আর এ ধরনের আচরণ যে আসলে অসদাচরণ—এ বিষয়েই জানেন বা মানেন কয়জন? তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে শুকনা হাসি হেসে সহকর্মীসহ বেরিয়ে এলেন তিনি। ফেরার পথে গাড়িতে বসে তিনি ও তাঁর সহকর্মী পুরোপুরি নিশ্চুপ রইলেন সারাটা পথ।
নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর ও অশালীন বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মুরাদ হাসান মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরও তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং তিনি নিরাপদে দেশত্যাগ করতে পেরেছিলেন। এভাবে বারবার তাঁর মতো ক্ষমতাধর মানুষেরা দেশ, মন্ত্রণালয় কিংবা কর্মস্থল ত্যাগ করে কিংবা অপসারিত হয়ে পার পেয়ে যান। গুরু পাপে তাঁদের শাস্তি সামান্যই।
দিলশাদ আরা ভাবছিলেন ঘটনাটি নিজ প্রতিষ্ঠানে ঘটলে হয়তো তিনি অন্তত রিপোর্ট করার কথা ভাবতেন। কিন্তু প্রভাবশালীর দাপটে এ ধরনের ঘটনায় কী করা যেতে পারে, তা অনেক চিন্তাভাবনা করেও কূলকিনারা করতে পারলেন না তিনি।
দিলশাদ আরা নামটি ছদ্মনাম হলেও ঘটনাটি কিন্তু বাস্তব। হরহামেশা এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হন দিলশাদ আরার মতো হাজারো নারী। সমাজের উচ্চ স্তর থেকে নিম্ন স্তরে অহরহ ঘটে এসব ঘটনা। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয় তখন, যখন মন্ত্রণালয়, সচিবালয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা অতিক্ষমতাধর পুরুষ কর্তৃক নারীরা এ ধরনের হয়রানির শিকার হন।
মৌখিক হয়রানির ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেমন প্রমাণ থাকে না, তেমনি এসব ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে নারাজ অনেকেই। ফলে অধিকাংশ পীড়নকারীর চেহারাই অপ্রকাশিত রয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ বেরিয়ে আসে তাঁদের চেহারা। কিন্তু ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা এসব মানুষের চেহারা উন্মোচিত হবে কীভাবে? যে যেভাবে পারছেন, ক্ষমতা আর সুবিধাজনক সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নারীকে হয়রান করছেন।
ফাঁস হওয়া অডিও টেপের সুবাদে আমরা তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ডা. মুরাদ হাসানকে একজন প্রভাবশালী চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে হয়রানি করেছিলেন বলে জানতে পারি। ওই অভিনেত্রী হয়রানির শিকার হওয়ার পরও দুই বছর নিশ্চুপ ছিলেন। অবশেষে ফোনালাপ ফাঁস হলে বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। এ ফোনালাপ কেন, কী উদ্দেশ্যে এত বছর পর প্রকাশিত হলো, সে আলোচনার অবকাশ আছে নিশ্চয়ই। তবে যে উদ্দেশ্যেই ফোনালাপটি ফাঁস করা হোক না কেন, বিষয়টি যে সত্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর ও অশালীন বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মুরাদ হাসান মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরও তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং তিনি নিরাপদে দেশত্যাগ করতে পেরেছিলেন। এভাবে বারবার তাঁর মতো ক্ষমতাধর মানুষেরা দেশ, মন্ত্রণালয় কিংবা কর্মস্থল ত্যাগ করে কিংবা অপসারিত হয়ে পার পেয়ে যান। গুরু পাপে তাঁদের শাস্তি সামান্যই।
সব আলোচনা ফাঁস হয় না, সব সত্যও বেরিয়ে আসে না। তাই সাজা হয় না এ ধরনের হাজারো ক্ষমতাধরের। কোনো কারণে নোংরামি প্রকাশিত হলে সংবাদমাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, আবার কিছুদিন পর সে ঝড় থেমেও যায়। এ অপরাধীরা চাকরি থেকে অপসারিত হলেও তাঁদের মন থেকে কিন্তু বিকৃতি ও অপরাধপ্রবণতা অপসারিত হয় না। তাই নতুন পরিসরে বিপুল উদ্যমে তাঁরা আবার নিজেদের মনোরঞ্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশত্যাগ, চাকরিত্যাগ কিংবা অপসারণে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত করতে ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানে আছে সেফগার্ডিং পলিসি, জেন্ডার পলিসি কিংবা এ ধরনের নানা নীতিমালা। যদিও ভিকটিম ব্লেমিং সংস্কৃতি আর পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা—কাঠামোর কারণে নারীরা হয়রানির অভিযোগ করতে দ্বিধান্বিত থাকেন, তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু হয়রানি সৃষ্টিকারী এবং হয়রানির শিকার ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান যদি আলাদা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। আর হয়রানকারী পুরুষটি যদি ক্ষমতাধর হন, তাহলে তো কথাই নেই। কার কাছে কোথায় গিয়ে দিলশাদ আরার মতো নারীরা প্রতিকার পাবেন, সে বিষয়ে গোলকধাঁধায় পড়তে হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে মহামান্য হাইকোর্ট প্রদত্ত যে নীতিমালা আছে, তা পড়লে মনে হয় সেখানে অপরাধী ও অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আকারে–ইঙ্গিতে কিংবা অশালীন ভাষার প্রয়োগে নারীর সম্মানহানি ঘটলে নারী কোন আইন দ্বারা অপরাধীর সাজা দাবি করতে পারেন, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এরপর আছে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করাসংক্রান্ত জটিলতা। যেখানে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রমাণের অভাবে অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়, সেখানে এ ধরনের মৌখিক হয়রানি প্রমাণ করা যে কী কষ্টসাধ্য, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বাধ্য হয়ে এ ধরনের অশ্লীল ইঙ্গিত আর ভাষা হজম করতে হয় নারীদের।
প্রশ্ন হলো আর কতকাল আমরা মুরাদ হাসানের মতো অপরাধীদের মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে দেখব আর নিশ্চুপ দিলশাদ আরারা আর কতকাল বদ্ধ গাড়িতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন?
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী