এক মায়ের পাঁচ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন তিনজন—এ রকম একটা খবর পেয়ে বেশ আলোড়িত হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম জীবিত দুই ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে। ভেবেছিলাম, তাঁদের নিয়ে প্রথমে একটা ফিচার লিখব প্রথম আলোতে। তারপর একটা গল্প, এমনকি উপন্যাস লেখার ভাবনাও উঁকি দিয়েছিল মনে। প্রথমে দেখা করলাম বড় ভাইয়ের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপ হলো: একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়ের গল্পই তিনি আমাকে বললেন। পঁচিশে মার্চের রাতে কী দেখলেন, তারপর কারফিউ উঠে গেলে ভাইদের নিয়ে কীভাবে ঢাকা থেকে ত্রিপুরার আগরতলায় পালিয়ে গেলেন, সেখানে কত দিন থাকলেন, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে কীভাবে অংশ নিলেন, তাঁর ভাইয়েরা কে কোন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে গেলেন, তারপর কবে কীভাবে আগরতলা থেকে কলকাতা গেলেন—সবকিছুই বললেন তিনি।
তারপর গেলাম তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে বললেন, তাঁর বড় ভাইটি আমাকে যেসব গল্প বলেছেন, সব মিথ্যা, সব বানোয়াট; তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। প্রথমে তিন মাস আগরতলায়, তারপর বাকিটা সময় কলকাতায় তাস খেলে কাটিয়ে দিয়েছেন। ছোট ভাই আমাকে আরও বললেন, ‘আপনি আমার কাছে আসবেন দেখে আমার ভাতিজারা আমাকে ফোন করে আগেই বলে রেখেছে, “চাচা, প্রথম আলো থেকে আপনার কাছে লোক যাবে। আপনি প্লিজ, আব্বার মানসম্মান রাখবেন।” কিন্তু আমি তার মানসম্মান রাখব কীভাবে? সে তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানোয়াট কথাবার্তা বলে বেড়ায়।’
ফিরে এসে অফিসকে সবকিছু বললাম। অফিস আমাকে বলল, ‘বাদ দাও’। আমি বাদ দিলাম। কিন্তু ভাবনাটা মন থেকে গেল না। ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধের কথা যে এই প্রথম জানলাম, তা মোটেই নয়। এক ভাই আরেক ভাইয়ের বুকে ছুরি মেরেছে—এমন ঘটনার কথাও আমি জানি। কিন্তু দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে তাঁদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলবেন, একজন আরেকজনের ভূমিকাকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে সাক্ষ্য দেবেন—এ রকম আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আমি বরং শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, এক মায়ের সন্তান না হয়েও।
২.
আমি যখনই আমার নিজের শহরে যাই, সেখানকার বয়স্ক লোকজনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুনতে চাই। এটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার প্রস্তুতির অংশ। একবার শুনলাম, একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে যেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই শহরে
প্রথম ঢোকে, মুসলিম লীগের সমর্থক ও পাকিস্তানপন্থী কিছু সাধারণ লোক লগির মাথায় পাকিস্তানি পতাকা বেঁধে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ আর ‘খোশ আমদেদ’ স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে।
পাকিস্তানি বাহিনী দেখে, বাঙালিরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছে, তারা কী স্লোগান দিচ্ছে আর কিসের ঝান্ডা বয়ে নিয়ে আসছে, তাতে কিছু এসে-যায় না। সৈন্যরা মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ১১ জন বাঙালি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। ওই ১১ জন বাঙালিই আমার শহরের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে প্রথম নিহত হয়, যারা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে মাসোহারার বিনিময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি-নিধন অভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেত। একজন আমাকে বলেন, ওই ১১ জনের মধ্যে আমাদের শহরের এক সাবেক মেয়রের বাবাও ছিলেন, যাঁর নাম এখন ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সরকারি নথিভুক্ত এবং তাঁর পরিবার সরকারি ভাতা পাচ্ছে।
আমি আরও শুনতে পাই, একাত্তরের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন আমার শহরের আশপাশের গ্রামগুলো থেকে বাঙালিরা এসে আক্রমণ চালায় আমার শহরের একমাত্র বিহারিপাড়ায়। সে পাড়ার একটা পুকুরে বিহারিদের তিনটা লাশ ভাসতে দেখা যায়। একাত্তরে আমার শহর প্রথম যে তিনটা লাশ দেখে, সেগুলো ছিল বিহারিদের। আবার, লোকজন আমাকে এ কথাও বলেছিল যে বিহারিপাড়ার মানুষগুলোকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ছেলেরা রাত জেগে পাহারা দিয়েছিল।
আমি প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শুনেছি, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী সান্তাহার পৌঁছার পর সেই জংশনের নাম পাল্টে রেখেছিল ‘শহীদাবাদ’। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে পৌঁছার আগে বাঙালিদের হাতে বিহারিরা প্রচুর সংখ্যায় মারা পড়েছিল।
৩.
এক নৌকমান্ডো, যিনি মংলা-সুন্দরবন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সুইসাইড স্কোয়াডের ‘ফ্রগম্যান’ ছিলেন, বুকে লিমপেড মাইন বেঁধে মাইলের পর মাইল সাঁতরে গিয়ে বিদেশি জাহাজের গায়ে মাইন সেঁটে দিয়ে দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে হেঁটে যশোর এলাকার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার অভিজ্ঞতার গল্প। সীমান্ত পার হওয়ার আগের রাতে তিনি ও তাঁর এক সহযোগী আশ্রয় নিয়েছিলেন সীমান্তের ঠিক লাগোয়া এক গ্রামের একটা বাড়িতে। সেই বাড়ির মালিক ছিলেন এক বয়স্ক মানুষ, দাড়ি-গোঁফে ভরা মুখ, মাথায় সব সময় টুপি। আমার নৌকমান্ডো বন্ধুটি সে সময় জানতেন না যে ওই ‘মুরব্বি’ ছিলেন একজন বড় ‘রাজাকার’, সেখানকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। ওই বাড়িতে সেই রাতে আমার বন্ধুটি যে খাবার খেয়েছিলেন, তার কথা এখনো ভুলতে পারেননি। তারপর তাঁদের ঘুমানোর জায়গা দেওয়া হয়েছিল, ভোররাতে ফজরের নামাজের আজানের শব্দ যখন ভেসে আসছিল, তখন সেই বর্ষীয়ান গৃহকর্তা আমার বন্ধু ও তাঁর সঙ্গীকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলেন, ‘এখন পাকিস্তানি সৈন্যদের ডিউটি বদল হবে। এই ফাঁকে তোমরা সীমান্ত পার হয়ে চলে যাও।’
এভাবে আমার বন্ধুটি একজন বিরাট ‘রাজাকারের’ সহযোগিতায় সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন, মাইন পেতে বিদেশি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোটের বিরুদ্ধে জলযুদ্ধে লড়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার গিয়েছিলেন সেই গ্রামে, সেই মুরব্বিকে খুঁজতে, তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে। কিন্তু গিয়ে শুনতে পান, ১৬ ডিসেম্বরের পর আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে মেরে ফেলেছেন। কারণ, তিনি ছিলেন বিরাট রাজাকার, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
৪.
প্রিয় পাঠক, এখন মার্চ বা ডিসেম্বর নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংবাদপত্রের পাতায় কিছু লেখার মৌসুম জুন মাস নয়। তবু ওপরের কথাগুলো লিখলাম। কারণ, আমাদের সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ‘বিকৃতি’ ও ‘অস্বীকার’ থেকে রক্ষা করার মানসে একটা আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ওই আইনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক কালপর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সরকারি ভাষ্যে এ পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে, তার ‘ভুল বিশ্লেষণ’ বা ‘সমালোচনা’, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে ‘ভুল তথ্য বা অর্থ-সত্য’ প্রচার করা যাবে না। এসব কাজ হবে দণ্ডনীয় অপরাধ, এসব অপরাধের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হবে।
এ রকম একটা আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জেনে মনে প্রশ্ন জাগল, এবার কি গল্প-উপন্যাস লিখে জেল খাটতে হবে? বড়ই মুশকিলের কথা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনটা? ওই দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে কার ভাষ্য আমি নেব? আমার শহরের ওই ১১ জন মানুষকে আমরা কী বলব? তারা কি ‘শহীদ’? বিহারিপাড়ার পুকুরে তিন বিহারির লাশ ভেসেছিল, এ ঘটনা আমার গল্পে
থাকলে, কিংবা সান্তাহার জংশনের নাম ‘শহীদাবাদ’ জংশন হয়েছিল, কিংবা শান্তি কমিটির এক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পার হতে সহযোগিতা করেছিলেন, আবার যুদ্ধ শেষে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে হত্যা করেছিলেন—এসব ঘটনা আমার উপন্যাসে থাকলে কি পঁচিশে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলি অস্বীকার করা হবে? সেই অপরাধে দণ্ডিত হয়ে আমাকে কারাগারে যেতে হবে?
যারা গল্প-উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি লেখে, চলচ্চিত্র বানায়, ছবি আঁকে, গান গায়—অর্থাৎ সৃজনশীল শিল্পের সঙ্গে জড়িত সবার মনে এ রকম একটা আইন কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? সরকারের নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা প্রমুখ বড় বড় মানুষ যদি মনে করেন, শিল্প-সাহিত্য গৌণ বিষয়, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মনের স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ‘অরক্ষিত’ রাখা চলে না, তাহলে আরও বড় প্রশ্ন তুলি: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মালিক কে? সরকার? কোনো রাজনৈতিক দল? আর ইতিহাস ‘রক্ষা’ করার আইন প্রণয়নের অধিকার বা ক্ষমতা কে কাকে দিয়েছে?
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কি এতই ছোট বিষয় যে তাকে আইন দিয়ে বাঁধাই করা যাবে?
না। মুক্তিযুদ্ধ অনেক অনেক বড় বিষয়, এর ইতিহাসের খুব সামান্য অংশই লেখা হয়েছে; অনাগত হাজার বছর ধরে তিলে তিলে রচিত হবে এর ইতিহাস। শুধু আমরা লিখব না, লিখবে আমাদের সন্তানেরা, তাদের সন্তানেরা, তাদেরও সন্তান-সন্ততিরা।
যাঁরা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঠুলি চোখে পরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নির্মীয়মাণ সৌধটিকে খর্বাকৃতি বামন করে রাখার বন্দোবস্ত করতে চাইছেন, তাঁদের সুমতি ফিরুক—কায়মনোবাক্যে এই কামনা করি।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।