বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের আয়োজনে ডিসেম্বরে পক্ষকালব্যাপী ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা নাট্যোৎসব ২০২১’ হলো। দেখলাম থিয়েটারের নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সেদিন ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও নাটক দেখতে এসেছিল। আয়োজকেরা জানান, তাঁরা উৎসবের পুরো সময়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছেন। বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশে থেকেছি। তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস নিয়ে শিক্ষিত করে—এমন বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে কাজ করার সময় প্রায়ই পোর্ট মোর্সবি এয়ারপোর্টে কোকোডা ট্রেইলে আসা অস্ট্রেলীয় পর্যটকদের দেখতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাপুয়া নিউগিনিতে অস্ট্রেলীয়রা জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল বেশ কিছু স্থানে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোকোডার যুদ্ধ। পাপুয়া নিউগিনির মধ্যাঞ্চলীয় সেন্ট্রাল প্রদেশে শুরু হয়ে উত্তরের ওরো প্রদেশের কোকোডা গ্রামে এসে শেষ হয় হাঁটা, ভীষণ বন্ধুর ও বিচ্ছিন্ন এ পথ। মাউন্ট বেলামির শীর্ষে এর উচ্চতা ২ হাজার ১৯০ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৯৬ কিলোমিটার। প্রতিবছর কয়েক হাজার অস্ট্রেলীয় পর্যটক সেখানে যান এবং যে পথ দিয়ে যোদ্ধারা গিয়েছিল, সে পথে হাঁটেন। এটি পাপুয়া নিউগিনিতে অস্ট্রেলীয়দের জন্য সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ। একে কেন্দ্র করে যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। সাধারণত ৪ থেকে ১২ দিন লাগে ট্রেইল শেষ করতে। দিনে প্রচণ্ড গরম, রাতে ঠান্ডা; বৃষ্টি, ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি ইত্যাদি থাকায় এ যাত্রা সহজ নয়। আমার এক অস্ট্রেলীয় সহকর্মী জানান, কেউ কেউ পুরো ট্রেইল শেষ করেন, কেউবা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যান। যাঁরা আসেন, তাঁদের অনেকের আত্মীয় এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা নিহত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পরবর্তী প্রজন্ম এ ট্রেইলে অংশ নেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের গালিপলিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় আট হাজার সৈন্য প্রাণ হারান। অনেক অস্ট্রেলীয় তুরস্কে যান শুধু তাঁদের স্মরণ করার জন্য; এটা অনেকের সারা জীবনের স্বপ্ন। মেলবোর্নে আমার এক বন্ধু জানিয়েছিলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে নিজে খণ্ডকালীন কাজ করে টাকা জমিয়ে বেশ কয়েকটি দেশে যাবেন। দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কও আছ। এর প্রধান কারণ গালিপলি ভ্রমণ। তরুণ অস্ট্রেলীয়দের দেশপ্রেম সম্পর্কে জেনে ভালো লেগেছিল। কিন্তু এ অনুভূতি তাঁদের মধ্যে তৈরি করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কার্যক্রম চলে। লন্ডনে দেখেছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, গ্যালারি ইত্যাদি শিশুদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে জানতে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
এ বছর ঢাকার একটি এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা আয়োজিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অল্প কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান ও নাচ ছিল। কিন্তু বাকি অনুষ্ঠানে প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে এমন সব গান পরিবেশিত হলো যে মনে হচ্ছিল বিজয় দিবস উদ্যাপন নয়, একটা কনসার্ট হচ্ছে। বেশ কিছু কিশোর-কিশোরীকে গানের তালে তালে নাচতেও দেখা গেল। আয়োজকদের একজন বক্তৃতায় জানালেন, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানানো অনুষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা এ বিচিত্রানুষ্ঠান থেকে ইতিহাস নিয়ে আদৌ কিছু শিখল কি? বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে গিয়ে তরুণদের লাউড স্পিকার বাজিয়ে ডিজে পার্টি করা গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এ প্রবণতা উদ্বেগজনক। তবে কেন এ পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা বিশ্লেষণ করা দরকার।
যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক দিকের পাশাপাশি অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অসাধারণ সাহস, ধৈর্য, ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাসও শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জানানো দরকার
বাংলাদেশে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানানোর জন্য অল্প কিছু উদ্যোগ আছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। বর্তমান প্রজন্ম যাতে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দেশটাকে আগামীর দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার জন্য আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। শুধু ডিসেম্বর বা মার্চ মাস নয়, সারা বছর ধরেই এ চর্চা করতে হবে। পরিবারের যেসব সদস্যের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা শিশুদের গল্প শোনাতে পারেন। বিভিন্ন জাদুঘর, গ্যালারি এবং স্কুল-কলেজগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক নানা ধরনের সৃজনশীল ও ইন্টার-অ্যাকটিভ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া যায়। সেখানে শিশু ও কিশোর-কিশোরদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। তারা ইতিহাস নিয়ে শিখবে, বিভিন্ন বিষয়ে মতামত প্রকাশ ও প্রশ্ন করবে। শিশুদের জন্য আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ভালো মানের বই, নাটক, চলচ্চিত্র, অ্যানিমেশন ইত্যাদির প্রয়োজন। সেগুলো এমন হবে, যাতে শিশুরা ইতিহাস নিয়ে আরও জানায় আগ্রহী হয়, দেশকে ভালোবাসতে শেখে।
বাংলাদেশজুড়েই এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্ন আছে। সেই সঙ্গে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের অসমসাহসী যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান ও স্থাপনা। এ ধরনের সবকিছু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে। এগুলোকে ঘিরে সারা বছর শিক্ষামূলক কার্যক্রম চলতে পারে এবং সেখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া উচিত। যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক দিকের পাশাপাশি অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অসাধারণ সাহস, ধৈর্য, ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাসও শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জানানো দরকার।
বিশেষজ্ঞরা একমত যে যুদ্ধের বীভৎসতার ছবি ও গল্প শিশুদের মনে চাপ তৈরি করে। তাই যুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে তাদের বয়সের উপযোগী করে, সততার সঙ্গে এবং সহজ ভাষায়। বিষয়টি মা-বাবা, শিক্ষক, লেখক, শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শিশুরা যাতে মানবিক হয়ে বেড়ে ওঠে, জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু করার প্রেরণা পায়, তা নিশ্চিত করা উচিত।
অস্ট্রেলিয়ার অনেক শহরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে সড়কের দুপাশে গাছ লাগানো হয়েছে। একেকটি গাছ একেকজন বীরের জন্য। এ সড়কগুলো ‘অ্যাভিনিউ অব অনার’ নামে পরিচিত। পদমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং সব যোদ্ধাকে একইভাবে শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টা খুব ভালো লেগেছিল। স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশে আমরা সবাই মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে নানা বয়স, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশার মানুষ একসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নতুন গাছ রোপণ করব। গাছগুলো নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠবে। সেই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শিশুরা বড়দের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইবে, ‘চাষাদের মুটেদের মজুরের/ গরিবের নিঃস্বের ফকিরের/ আমার এ দেশ সব মানুষের...।’
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী