সম্প্রতি একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে—মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান নিয়ে তাঁর বিরোধী পক্ষের লোকজন অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এমনও বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান যুদ্ধ করেননি। তিনি পাকিস্তানের চর ছিলেন। এক হীনম্মন্যতা থেকে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে এসব প্রচার করা হচ্ছে। মাঠের যুদ্ধ থেকে যাঁরা দূরে ছিলেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে এ ধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করে। মাঠের প্রকৃত বীর যোদ্ধাদের নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা সমীচীন নয়। এতে তাঁদের দুর্বলতা ও ক্ষুদ্রতারই প্রকাশ ঘটে।
আজ সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনাসদস্যের হাতে নির্মমভাবে তিনি নিহত হন। এরপর নানা উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের নাম ও জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। জিয়াউর রহমানের বড় গুণ ছিল, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং পরবর্তী সময়ে এ সিদ্ধান্তগুলো জিয়াউর রহমান ও বিএনপির জন্য সুফল বয়ে এনেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এর শুরু এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও এর প্রতিফলন দেখা যায়। জিয়াউর রহমান সম্ভবত দীর্ঘসূত্রতা পছন্দ করতেন না। এ কারণেই তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
জিয়াউর রহমানের সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রবর্তন করে দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দেওয়া, প্রতিরক্ষার জন্য শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করা, খাল খনন, গ্রাম সরকার, কৃষির উন্নয়ন, গণশিক্ষা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমের রাষ্ট্রের একটি গণচরিত্র গঠন করা, জনজীবনে নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা, দক্ষ ও কৌশলী আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার উদ্যোগ, বেকারত্ব হ্রাস করা, শিল্পকারখানায় উৎপাদনের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, মেয়েদের স্কুল ফুটবল শুরু করা, জাতীয় ক্রিকেট দল গঠন করা, চলচ্চিত্রে অনুদানপ্রথা চালু করা, একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রবর্তন করাসহ অনেক কিছু নিয়েই আলাপ-আলোচনা করা যায়।
জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে জিয়া রাজনৈতিক চেতনায় সীমাবদ্ধ না রেখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ফলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের হাত ধরে জিয়াউর রহমানের আমলে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটতে শুরু করে। নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হয় এ সময়। গ্রামীণ জীবন থেকে ক্রমে শহুরে নাগরিক জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে মধ্যবিত্তরা। নতুন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই এখন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে সৃষ্টি হওয়া শহরভিত্তিক এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশাল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলাদেশি বা বাংলাদেশপন্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই মধ্যবিত্তরা।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের পতনও হতে পারে। তবে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের অর্থনীতির বিকাশে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এক দুরূহ কাজ। সম্ভবত না বুঝেই তাঁর প্রতিপক্ষ অসম্ভব এ কাজ শুরু করেছে। স্বভাবতই তারা ব্যর্থ হবে। আবার বিপরীতে আরেক পক্ষও কামিয়াব হবে না। তারা জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরতে চাইছে। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে-বাড়িয়ে বলেও জিয়াউর রহমানকে তাঁর অবস্থান থেকে ওপরে তুলে আনা যাবে না; বরং ইতিহাসই নির্ধারণ করবে স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডার এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের অবস্থান।
১৯৭১ সালের রাজনৈতিক চেতনাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে রূপান্তরের কাজ জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামল সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের মেলবন্ধন একটি দেশের পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই সময় অর্থনীতি, সংস্কৃতি—সব দিকেই বাংলাদেশের নিজস্ব পরিচয় গড়ে উঠতে শুরু। আমাদের তৈরি পোশাক এখন সারা বিশ্বেই সমাদৃত হচ্ছে। অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, কৃষি ও ইলিশের উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অনন্য এক উদাহরণ। প্রবাসী শ্রমিকেরা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে অন্যতম ভরসার নাম। এসবই নতুন নিজস্ব পরিচয় নির্মাণের প্রক্রিয়া। ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক লড়াইয়ে যে নতুন পরিচয় গঠিত হয়েছিল, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের সাফল্য স্বতন্ত্রভাবে তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। এ সবকিছুরই সূচনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে।
এরপরও শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানের যথেষ্ট সমালোচনা আছে। তাঁর অনেক কর্মকাণ্ড সবার পছন্দ না–ও হতে পারে। একদিকে তিনি স্বাধীনতা-উত্তরকালে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা করেন। আবার তাঁর শাসনামলে সংবিধানে ধর্মকে ব্যবহার করা, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া, কর্নেল তাহেরসহ সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার আইনগত ভিত্তি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিরে আনার কার্যকারণ নিয়ে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া হয়। এ ধরনের বিশ্লেষণ সব শাসককে নিয়েই হয়। জিয়াউর রহমানও ভুলভ্রান্তির জন্য সমানভাবেই সমালোচিত ও নিন্দিত হবেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের পতনও হতে পারে। তবে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের অর্থনীতির বিকাশে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এক দুরূহ কাজ। সম্ভবত না বুঝেই তাঁর প্রতিপক্ষ অসম্ভব এ কাজ শুরু করেছে। স্বভাবতই তারা ব্যর্থ হবে। আবার বিপরীতে আরেক পক্ষও কামিয়াব হবে না। তারা জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরতে চাইছে। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে-বাড়িয়ে বলেও জিয়াউর রহমানকে তাঁর অবস্থান থেকে ওপরে তুলে আনা যাবে না; বরং ইতিহাসই নির্ধারণ করবে স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডার এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের অবস্থান।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা পরবর্তী সময়ে দেশ শাসন করতে সুবিধা দিয়েছিল। তিনি দুই দফায় জনসাধারণের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। পরে শাসক হিসেবে। ১৯৭১ সালে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসের বাঙালি সেনা কর্মকর্তারাও বিদ্রোহ করেন। তবে জিয়াউর রহমান বেতারে ঘোষণা দিয়েই যুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর ঘোষণাটি সারা দেশেই প্রচারিত হয়। এটা জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত, উদ্বেলিত ও আশান্বিত করে। ১৯৭১ সালের কাছাকাছি সময়ে আলজেরিয়া ও লিবিয়ার গেরিলা যোদ্ধারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। আমাদের গেরিলারাও নতুন ইতিহাস নির্মাণের পথে এগিয়ে যান। জিয়া এই ঐতিহাসিক লড়াইয়ের অন্যতম যোদ্ধা।
● ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক