এরশাদবিরোধী আন্দোলন শেষ দিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে রূপ নিয়েছিল। গণ-আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন নূর হোসেন। কামরুল হাসানের ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ জনগণ নিজ খরচে ফটোকপি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করেছে। পথনাটক, গণনাটক, পুঁথিপাঠ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পেশাদার নাট্যশিল্পীর প্রয়োজন হয়নি। অসংখ্য স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভা সময়ের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছিল অভিনেতা-গায়ক-কবি আঁকিয়ে। এরশাদের পতনে অসামান্য ভূমিকা রাখে এসব সৃজনশীল নান্দনিক ক্রীড়াকৌতুক।
মিয়ানমারেও এখন সেই পালা চলছে। গণ-আন্দোলনকে উপজীব্য করে সেখানে শুরু হয়ে গেছে নান্দনিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। প্রথম দিকে জান্তাবিরোধী গণ-আন্দোলনে তিন আঙুলের স্যালুটটিই বেশি আলোচিত হচ্ছিল। হলিউডের ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হাঙ্গার গেমস–এর কল্যাণে দুনিয়াজুড়ে স্যালুটটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সিনেমাটিতে সর্বাত্মকবাদী শাসনব্যবস্থার অধীন মানুষ দুঃশাসন কাটাতে, তাদের প্রতিনিধিকে সাহস জোগাতে, শ্রদ্ধা জানাতে এবং সংহতি প্রকাশ করতে তিন আঙুলের এই স্যালুট চিহ্নটি ব্যবহার করে। ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে সেনাবিরোধী গণ-আন্দোলনে স্যালুটটি সংহতির চিহ্ন হয়ে ওঠে। যদিও সেই ১৯০৮ সাল থেকেই স্কাউটিংয়ে তিন আঙুলের স্যালুট চালু আছে, সেই স্যালুটটির অর্থ ছিল স্বেচ্ছাসেবা দিতে আমরা এক পায়ে খাড়া। চলতি বিক্ষোভগুলোতে সেই উদ্দীপনাটিও যুক্ত হয়েছে।
বর্তমানের স্যালুটটি অবশ্য স্কাউটদের মতো কপাল ছুঁয়ে থাকে না। মাথার ওপরে শূন্যে শপথের ভঙ্গিতে উত্তোলিত করা থাকে। মিয়ানমারেও ভঙ্গিটি এখন আন্দোলনের সংহতির স্মারক। স্যালুটটি যাঁরা প্রথম দেখলেন, তাঁদের ঔৎসুক্যের সীমা ছিল না। অন্তর্জালে স্যালুটটি নিয়ে রগড়-কৌতুকও চলছিল। এমন নয় যে কৌতুককারীরা এই স্যালুটের মর্মার্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বরং সজ্ঞানেই তঁারা রগড়ে নেমেছিলেন। কেউ কেউ এ রকম কৌতুকও করেছেন যে মিয়ানমারের জনগণ ‘ভি-চিহ্ন’ দেখাতে জানে না বা জানলেও দেখাবে না। কারণ, তারা জানে ‘ভিক্টরি’ বা বিজয় তাদের কপালেই নেই। থাকলে কি আর প্রায় ৬০টি বছর ধরে জান্তার শাসন চলে!
সত্যিই তো মিয়ানমারে যে মানুষটির বয়স এখন ষাট, তিনিও জীবনে গণতন্ত্রের স্বাদ পাননি। তারপর আরও তিন-চারটি প্রজন্ম এসেছে। অথচ যাদের জন্ম ২০১০ বা তারপর, তারাও দেখছে জনগণের সরকারের নামে ক্ষমতার কলকাঠি আসলে জান্তাই নাড়ছে। ১৯৮৮-এর ৮ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে একনায়ক নে উইনের পতন ঘটলেও জান্তার শক্তিতে বিশেষ ভাটার টান লাগেনি। বরং তারা কীভাবে আরও শক্তিশালী হওয়া যায়, সেই চেষ্টাচরিত্রই করেছে। মিয়ানমারবাসীর কাছে এই দম বন্ধ করা কর্তৃত্ববাদী শাসন হাঙ্গার গেমস–এর নৈরাজ্যকর ডিস্টোপীয় শাসনের মতোই।
বিশ্বময় স্যালুটটি আলোচিত হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের উৎসাহে যেন হাওয়া লেগেছে। বড় বড় শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও লোকজন আন্দোলনকে রঙিন ও চিত্তাকর্ষক করে তুলছেন। বিচিত্র সাজে সাজছেন তাঁরা। কখনো শব, কখনো ভূত, কখনো সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ক্যাটওম্যানের মতো ফ্যান্টাসি চরিত্র সাজছেন। ছোট ছোট নাটক ও প্রহসনপালায় দেখিয়ে চলছেন বার্মাকে আসলেই একটি ডিস্টোপীয় সমাজ বানিয়ে ছেড়েছেন সেনারা। পথনাটক ও প্রহসনগুলোতে এ ভাষ্য স্পষ্ট করে তোলা হচ্ছে যে অর্থনীতি, জিডিপি-জিএনপি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের দেখভাল করা সেনাদের কাজ নয়। পৃথিবীজুড়েই এ প্রতিষ্ঠানের কাজ দেশরক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানো। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বড় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) এবং মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেডের (এমইএইচএল) মূল কর্ণধার সেনাবাহিনী।
অর্থ অনর্থের মূল। পৃথিবীর যত দেশেই সেনাবাহিনী বাণিজ্য-বেসাতিতে নেমেছে, সবগুলোর পরিণতি একই—গণতন্ত্রহীনতা ও সীমাহীন দুর্নীতি। উদাহরণ সোমালিয়া, সুদান, জিম্বাবুয়ে, উগান্ডা, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশ। মিয়ানমারের নতুন প্রজন্ম তাদের মাতৃভূমিকে এভাবে তলিয়ে যেতে দিতে পারে না। তাঁরা দেখাচ্ছেন মিয়ানমারের বর্তমান প্রজন্ম যে ভীতিবাস্তবতায় এত দিন ধরে বসবাস করে চলেছে, এখন তার ‘হয় মরো নয় মারো’ দশা চলছে। হয় নিজেরা বিদায় নেব অথবা যারা এত দিন ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রেখেছে তাদেরই বিদায় করব—এ রকম সংকল্প তিন আঙুলের স্যালুটে প্রদর্শিত হচ্ছে। এ প্রজন্ম আগের মতো অন্ধকারে নেই। ইন্টারনেটের কল্যাণে তারা জানে গণতন্ত্র পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন দেশে কোনরূপে টিকে আছে। যেখানে যেখানে আধা বা সিকি গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে সেখানে সম্ভাবনার দিকগুলোও তাদের জানা।
তাই মিয়ানমারে তৈরি হচ্ছে প্রতিবাদের উদ্ভাবনী সব ভাষা। চীনা দূতাবাসের সামনে সিসি ক্যামেরার নিচে নিন্দাজ্ঞাপক প্ল্যাকার্ড তুলে ধরছেন তরুণ-তরুণীরা। আন্দোলন দমাতে চীন লরিভর্তি অস্ত্র পাঠাচ্ছে, জেনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রতিবাদকারীরা, শেষে দূতাবাস কৈফিয়ত দেয় যে অস্ত্র নয়, মাছ এসেছে। তরুণ-তরুণীরা এখন দূতাবাসের নাম দিয়েছেন ‘মাছের আড়ত’। রোহিঙ্গাদের প্রতি যে অবিচার হয়েছে এবং সেনাবাহিনীই যে গণহত্যার ক্রীড়নক, এ সত্যও নৃত্যে-নাটকে-গানে উদ্ভাসিত করে তুলছেন আন্দোলনকারীরা। এ সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি পরিবর্তনের বার্তা এবং মিয়ানমারের নতুন প্রজন্মের গণতন্ত্রের প্রত্যাশা।
তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এ গল্পও ছড়িয়ে দিচ্ছে যে ২০১০ সাল থেকে অং সান সু চি স্টেট কাউন্সেলর নামের এক বিচিত্র পদে রয়েছেন। মিলিটারির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তৈরি হওয়া ২০০৮ সালের সংবিধান এই একটি রাজনৈতিক পদের ব্যবস্থা রেখেছে। স্টেট কাউন্সেলর কাগজে-কলমে অসামরিক রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু পেছনে বন্দুক নিয়ে সার্বক্ষণিকই খাড়া সামরিক বাহিনী। পেছনের মানুষের অঙ্গুলিহেলনের বাইরে স্টেট কাউন্সেলরের করার কিসসুটি ছিল না। তাই ১৯৬২ সালের পর জন্ম নেওয়া মিয়ানমারবাসীর কাছে গণতন্ত্র একটি রূপকথা, গল্পে আছে বাস্তবে নেই।
মিয়ানমারবাসী তবু স্টেট কাউন্সেলর ব্যবস্থাটিকে ‘মন্দের ভালো’ ধরে নিয়েছিল। আশায় বুক বেঁধেছিল। আশা ছিল এভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে একসময় সত্যিকারের গণতন্ত্রের মুখ দেখতে পাবে তারা। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। তাই এখনই সময় প্রতিরোধের।
হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়