প্রায় চার দশকের পুরোনো রোহিঙ্গা ইস্যু এবার বাংলাদেশের ওপর যেভাবে চেপে বসেছে, তাতে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বিদেশি মিশনের লোকজনকে ডেকে নিয়ে দেশে দলে দলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢুকে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এই কাজ শুরু করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি হচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও সমস্যার সমাধানে তুলে ধরা প্রস্তাব। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যে ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছি, তার ফসল ঘরে তুলতে হলে আমাদের যে তৎপরতা দরকার, তা যথাযথভাবে হচ্ছে কি?
মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। কিন্তু এমন মাত্রায় চাপ এখনো দেখা যাচ্ছে না, যা মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাধ্য করতে পারে বা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের অনেক বড় নেতার মুখে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম, কানাডা রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিলেও জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করলেন না। তাঁর মুখ থেকে অন্তত রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু কথা শোনার আশা করেছিলেন অনেকে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন এই আত্মবিশ্লেষণ জরুরি যে এই অধিবেশনের আগে বা চলার সময় আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট জোরালো ছিল কি? নাকি বাংলাদেশের তরফে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার সুযোগ ছিল।
একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিবের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলাম। তিনি বললেন, ‘এ নিয়ে কী বলব বলুন। আসলে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যা বোঝার আপনি বুঝে নিন।’ পাঠক, এই মন্তব্য থেকে আপনারা কী বুঝলেন বা কী অনুমান করতে পারছেন? আমি যা বুঝলাম তা হচ্ছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ ছিল। সেখানে আমাদের আরও কিছু করণীয় ছিল।
ইউনাইটেড নেশনস নিউজ অ্যান্ড কমেন্ট্রি ফোরাম, ইউএন ডিসপ্যাচ এর এক পর্যালোচনায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে পাঁচটি দিকে নজর রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তাতে ৩ নম্বরে ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। কিন্তু এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এই ইস্যু সেই মাত্রার গুরুত্ব পায়নি। সেখানে আমাদের যদি কোনো ঘাটতি থেকে থাকে, তা বোঝা এই কারণে জরুরি যে আগামী বৃহস্পতিবার সাতটি সদস্যদেশের অনুরোধে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসছে। এর আগে সময় হয়তো একদমই নেই কিন্তু এরপরও কূটনৈতিকভাবে করার কিছু থাকলে সেটা যেন আমরা জোর দিয়ে করতে পারি।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বলেছেন, এত দ্রুত শরণার্থী-সংকট কোথাও এত প্রকট হয়নি। ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ৪ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া মুখের কথা নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ বইতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের জন্য এই চাপ সত্যিই অসহনীয়। আরাকান রাজ্যের সংকটের কোনো দায় বাংলাদেশের না থাকলেও মানবিক বিবেচনায় কাজটি বাংলাদেশকে করে যেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য সবচেয়ে হতাশার হচ্ছে কিছু বন্ধুদেশ বাংলাদেশের চাওয়া অনুযায়ী পাশে নেই।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার অবস্থান স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষে। জাপান এ নিয়ে তেমন রা করছে না। তবে শরণার্থীদের সহায়তায় তারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ—দুই দেশকেই সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী এইচ ই আইওয়া হওরি ২২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সফরের সময় বলেছেন, মিয়ানমারকে সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার যে নীতি জাপানের আছে, তা পরিবর্তন হবে না। রাখাইন ইস্যুতে তিনি মিয়ানমারকে ১০ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।
অথচ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ইস্যুতে এই দেশগুলোর সমর্থন বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা সমস্যাটির ব্যাপারে চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো সহানুভূতিশীল হলে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজটি সহজ হতো। এখানেও আবার সেই কূটনীতি ও এর সফলতার প্রশ্নটি চলে আসে।
এই দেশগুলোর এমন অবস্থানের পেছনে বিশ্লেষকেরা প্রায় একমত যে অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক কারণেই তারা এই অবস্থান নিয়েছে। সবাই বলছেন, মিয়ানমারে ভারত, চীন, রাশিয়া ও জাপানের বিশেষ স্বার্থ রয়েছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ। আর মিয়ানমারের ভূকৌশলগত অবস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশ বুঝেশুনেই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে অথবা মিয়ানমারকে হাতে রাখার নীতি নিয়েছে। প্রথম আলোর টোকিও প্রতিনিধি মনজুরুল হক লিখেছেন, মিয়ানমার নিয়ে জাপানের অস্বস্তির প্রধান কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা দেশটিতে জাপানের সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিপুল বিনিয়োগ। এসব কথার মধ্যে যুক্তি নিশ্চয়ই আছে। সবাই সবার স্বার্থ দেখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মনে এই প্রশ্নও তো জাগে, বাংলাদেশে কি কারও কোনো স্বার্থ নেই? এখানে কি এই দেশগুলোর বিনিয়োগ নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। ভূকৌশলগত অবস্থান বা এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের কি কোনো দাম নেই। শুধু মিয়ানমারেরই আছে?
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই জোরালো। এ দেশে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে চীনের প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশের সমরাস্ত্র কেনার অন্যতম প্রধান উৎস চীন। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কেনা। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় গোটা তিরিশেক প্রকল্পের জন্য আড়াই হাজার কোটি ডলারের সমঝোতা হলো। চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের বিষয়টি পরিষ্কার। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ চীনকে কাছে পাবে না, এটা কেমন কথা!
ভারত আমাদের প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র। বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে উষ্ণতম পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা-শঙ্কা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্য, তা ভারতের অনুকূলে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা সম্পৃক্ত। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে ভারত। স্থল ও নৌ ট্রানজিটের বিষয় রয়েছে দুই দেশের মধ্যে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার সম্পর্কও এখন যথেষ্ট জোরদার। এখানেও সেই একই কথা, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে আমরা ভারতের সমর্থন পাব না কেন?
জাপান সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুদেশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা দেয়, এমন দেশগুলোর মধ্যে জাপানের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপান। ঢাকায় মেট্রোরেলের প্রকল্প চলছে। মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন ও কার্যত গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর কাজটি করছে জাপান। রাশিয়া বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে, গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করছে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্রও কিনছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের সঙ্গে এই দেশগুলোর যে মাত্রায় অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কোনো অংশেই কম হওয়ার কথা নয়। আমাদের মনে আছে, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর ব্যাপারে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের সব প্রস্তুতি ও ঘোষণার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তা করেননি। কারণ ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র এর বিরোধিতা করেছিল। সোনাদিয়া প্রকল্পটিই এখন হারিয়ে গেছে। পায়রায় এখন সমুদ্রবন্দর বানানোর কাজ করছে চীন। আর জাপান যে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক জোন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, সেখানে শেষ পর্যন্ত একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের পরিকল্পনার কথা জানা যাচ্ছে। এসব প্রমাণ করে যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ কোনোভাবেই গুরুত্বহীন নয়। সমস্যাটি তাহলে কোথায়? সমস্যাটি সম্ভবত রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথাযথ ও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগের ঘাটতি।
বাংলাদেশের কূটনৈতিকভাবে আরও কিছু করার ছিল কি না, এসব নিয়ে কথা প্রসঙ্গে একজন কূটনৈতিক প্রতিবেদক বললেন, ‘সব দেশ তাদের স্বার্থ দেখে। দূত পাঠিয়ে বা বাড়তি কূটনৈতিক তৎপরতায় খুব ফল দেবে বলে মনে হয় না।’ বিষয়টি কি শুধুই তা–ই বা এতটাই সরল? কূটনৈতিক ‘তৎপরতায়’ কি কোনো ফল মেলে না? বাংলাদেশ যদি ‘রোহিঙ্গা কূটনীতির’ অংশ হিসেবে কিছু দেশে প্রতিনিধি পাঠায়, তা কি কোনো ভূমিকাই রাখবে না? বাংলাদেশ যে বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, সেই বার্তা দেওয়া কি জরুরি নয়!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]