কয়েক ঘণ্টার সফরে ঢাকায় এসেছিলেন জন কেরি। ওবামা সরকারের সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালেও একবার ঢাকা এসেছিলেন কেরি। কাজেই এ দেশের নেতৃত্ব, রাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে তিনি বেশ ওয়াকিবহাল।
জলবায়ু–সম্পর্কিত শীর্ষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে এবার ঢাকা এসেছিলেন কেরি। বিশ্বনেতাদের এ সম্মেলনের মাধ্যমে আবার জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যাচ্ছেন জো বাইডেন। আগের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। জন কেরি জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সাহায্যে এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ুদূষণের মাত্রা কমাতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কে আরও উন্নয়নের বিষয়টি উল্লেখ করতেও ভোলেননি কেরি ।
কোনো সন্দেহ নেই, সম্পর্ক উন্নয়নের এ চেষ্টায় এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। যদিও ইন্দো-প্যাসিফিক স্টেটের জোট বিষয়ে কোনো কথা কেরি বলেননি। এটা তাঁর বিষয়ও নয়, তবে মিয়ানমারে গণতন্ত্র এবং বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রশংসা করে যা বলেছেন, তাতে বাংলাদেশকে কাছে টানার বিষয়টি দৃশ্যমান। ইদানীং ভারতেরও এমন প্রয়াস বেড়েছে। শুধু বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবেই নয়, চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের কারণেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। চীনের মহা-উদ্যোগ ‘বেল্ট রোড’ প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছে না—তার জানানও দিয়ে গেলেন কেরি। বাইডেন প্রশাসন যে ট্রাম্পের নীতিতে থাকছে না, কেরির সংক্ষিপ্ত সফর তেমনই ইঙ্গিত দেয়।
এ প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কেরি যা বলছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও শুধু কিছু আশ্বাস আর বাংলাদেশের প্রশংসা করা ছাড়া এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তেমন আর কিছুই করেনি। অবশ্য মিয়ানমারের অতীত এবং বর্তমান নিয়ে কিছু কথা বলেছেন কেরি। বলেছেন ওই সময়কার নেতা অং সান সু চি ও জেনারেলদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। তবে খেদের কথা হলো, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালে মিয়ানমারে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতার যৌথ সম্মতিতে যখন রোহিঙ্গা নিধন হচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কোনো দেশই সোচ্চার হয়নি। ওই সময় পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি ভারতসহ এশিয়ার বড় দেশগুলোও মিয়ানমার তোষণে ব্যস্ত ছিল। প্রায় ১১ লাখ বিতাড়িত রোহিঙ্গা যখন বাংলাদেশ আশ্রয় নেয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও জাতিসংঘের কল্যাণে বেরিয়ে আসে একটি জাতিগোষ্ঠী নিধনের ভয়াবহ চিত্র, তখনই কেবল বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। অবশ্য তখনো খুব তৎপর ছিল না মার্কিন প্রশাসন।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের কাছে রোহিঙ্গা বিষয়টি মোটেও আর অগ্রাধিকারে নেই। সামরিক জান্তা এখন নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত। মুখে না বললেও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনরোষের পেছনে যে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সায় রয়েছে, বেশির ভাগ বিশ্লেষণই তাতে একমত। মিয়ানমার সামরিক জান্তার আরেক বড় সমস্যা হলো চীনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনরোষ। ১৭ মার্চ ইয়াঙ্গুনের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে বেছে বেছে চীনা ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছিল। হ্লাং থারিয়ার নামক এই অর্থনৈতিক জোনে সিঙ্গাপুর, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক কারখানা থাকলেও শুধু চীনা স্থাপনায় আক্রমণ এবং তাঁদের গাড়ি ভাঙচুর চীনের বিরুদ্ধে জনরোষ বলে প্রচারিত হয়েছে। চীন অবশ্য এ কাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
চীন এই প্রথম মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সামরিক জান্তার ওপরে প্রকাশ্যে কোনো চাপ না দিলেও দ্রুত সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছে তারা। কারণ, ক্রমেই মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের আস্থা হারাচ্ছে চীন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাও চীন নিয়ে উৎকণ্ঠ। মনে করা হয়, ২৭ মার্চ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপরে কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির ভয়াবহ আক্রমণ চীনের মৌন সম্মতিতেই ঘটেছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রতি-আক্রমণে বায়ুসেনা ব্যবহার অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। একইভাবে অন্যান্য গ্রুপ, যাদের মধ্যে আছে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, বেশ কয়েক মাস নীরবতা পালন করে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপরে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এগুলোও সামরিক জান্তার ওপর চাপের আলামত। বিশ্লেষকদের মতামত যে চীন পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের সংকটের দ্রুত সমাধানের বার্তা দিচ্ছে।
রোহিঙ্গা যেন শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা। যদিও কেরি বিশ্বশক্তির কাছে এ সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে হয়তো এর বেশি আশা করা যায় না। কাজেই বাংলাদেশকেই কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। আসন্ন বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলতে হবে। তুলে ধরতে হবে ১১ লাখ রোহিঙ্গা উপস্থিতির কারণে কীভাবে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের পরিবেশ
এই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ কমাতেই ঘোষণা দিয়েছে যে ২০০৮-এর সংবিধান মোতাবেক দুই বছরের মাথায় নির্বাচন করবে। নতুন নির্বাচনে যে সরকার হবে, সন্দেহ নেই তাতে সু চি থাকবেন না। অনেকেই মনে করেন, এ বিষয়েও চীনের সম্মতি রয়েছে। অপর দিকে আসিয়ানসহ পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসুক চাইলেও সু চিকেই যে তারা সমর্থন করছে, তেমন কোনো প্রমাণও নেই। এমনকি সু চির দলের নির্বাসিত সরকার গঠনের প্রতিও এ পর্যন্ত কোনো সমর্থন পাওয়া যায়নি।
কাজেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আগামী দুই বছরেও মিয়ানমার সরকার বা জান্তা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে না। অপর দিকে পশ্চিমা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক কৌশল হবে মিয়ানমারকে চীনবিমুখ করা। রোহিঙ্গা এখানে প্রধান ইস্যু নয়। কাজেই কেরি বা বাইডেন প্রশাসনসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যু প্রাধান্য পাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র অথবা আন্তর্জাতিক অঙ্গন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপরে কোনো কার্যকর চাপ প্রয়োগ করার ইচ্ছা অথবা ক্ষমতা রাখে বলে মনে হয় না। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোরও একই অবস্থা। কীভাবে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত চীন-ভারত। তাদের অগ্রাধিকারেও তাই রোহিঙ্গা নেই।
রোহিঙ্গা যেন শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা। যদিও কেরি বিশ্বশক্তির কাছে এ সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে হয়তো এর বেশি আশা করা যায় না। কাজেই বাংলাদেশকেই কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। আসন্ন বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলতে হবে। তুলে ধরতে হবে ১১ লাখ রোহিঙ্গা উপস্থিতির কারণে কীভাবে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের পরিবেশ।
● এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)