মাহাথিরের নয়, ইমরান খান শুনলেন সৌদি ডাক
পাকিস্তানের ইমরান খান মাহাথির মোহাম্মদের ডাক শুনলেন না, শুনলেন সৌদি বাদশাহর নিষেধ।
ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন মানে শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা। উভয়সংকটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে টাল সামলানোই যেন তাঁর প্রধান কাজ। দেশের ভেতর তিনি সেনাবাহিনী আর জনগণের মধ্যে দোলায়মান থাকেন। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সৌদি-মার্কিন অক্ষ বরাবর ঘুরলেও এখন তাঁকে টানছে ইরান-তুরস্ক-মালয়েশিয়ার জোট। নৈতিকতার বেলাতেও ঘর-বাইরের বিরোধ মিটেছে কি না, বলা কঠিন। যৌবনে তিনি যাপন করেছেন পশ্চিমা কায়দার ব্যক্তিস্বাধীনতার সুখ, কিন্তু রাজনীতিতে নেমে তাঁকে দিতে হচ্ছে মুসলিম নৈতিকতার পরীক্ষা।
এই অবস্থায় ইমরানকে নতুন এক পরীক্ষায় ফেলেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। মাহাথির এত দিন তাঁর দেশের জন্য যা করার করেছেন, শেষ বয়সে তাঁর ইচ্ছা হয়েছে বিপাকে পড়া মুসলমানদের জন্য কিছু করবেন। এত দিন কাজটি বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে করলেও এবার তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ধরে টান দিয়েছেন। আরব বাদে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে কুয়ালালামপুরে এক সম্মেলন ডেকে ফেললেন। উদ্দেশ্য, রোহিঙ্গা, কাশ্মীর, উইঘুর, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক ও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার তাগিদ জাগানো।
১৯ থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সম্মেলনে ৫৬ টি মুসলমান দেশের প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রতিনিধি যোগ দেন। অথচ মুসলিম উম্মাহর সংহতির বদলে তা উন্মোচন করে দিল গভীর ফাটল। দেখা গেল মুসলিম দেশগুলোর ঐতিহাসিক বিভক্তির নতুন মঞ্চায়ন। সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এক প্রকার ভেটো দিয়ে বসে—তারা সম্মেলন বর্জন করে। সৌদি আরব শুধু এ সম্মেলনে অসহযোগই করেনি, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশকেও এ থেকে দূরে রাখে। নিরপেক্ষতা রক্ষার যুক্তিতে এসব দেশের হাজিরানা ছিল নামকাওয়াস্তে।
অন্যদের কথা থাক। ইমরান খান কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি স্বয়ং আসবেন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের পার্শ্ববৈঠকে কুয়ালালামপুর সম্মেলনের প্রস্তাব ইমরান খানকে জানান মাহাথির। এই কাজে মাহাথিরের সাথি ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি। ইমরান তখন কথা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান এ সম্মেলন সফল করায় কাজ তো করবেই, ইমরান নিজেও উপস্থিত থেকে মাহাথিরের হাত শক্তিশালী করবেন। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ইমরান ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক সম্মেলন থেকে নিজেকে সরালেন। অবশ্য তার আগে তিনি ছুটে যান সৌদি রাজধানী রিয়াদে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, তিনি গেছেন সৌদি বাদশাকে রাজি করাতে। কিন্তু নিন্দুকেরাবলে, আসলে গেছেন বাদশাহর অনুমতি প্রার্থণা করতে। ইমরানের পরামর্শে মাহাথির মোহাম্মদও সৌদি বাদশাহকে ভিডিও কনফারেন্সে সম্মেলনের দাওয়াত দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সৌদি আরব, কাতার ছাড়া অন্য কোনো উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র তো আসেইনি, উপরন্তু পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিনিধি ও পথ আর মাড়াননি।
সৌদি আরবের অভিযোগ বোধগম্য। তারা অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন তথা ওআইসিকেই মুসলিম ইস্যু আলোচনার একমাত্র মঞ্চ বলে মনে করে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই পাকিস্তানও বলতে বাধ্য হয়, তারা বিভক্তির বিপক্ষে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি নিশ্চিত করে বলেছেন, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কুয়ালালামপুর সম্মেলন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এই সম্মেলন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফাটল ধরাবে এবং ওআইসির সমান্তরালে আরেকটা সংগঠন গড়ে তুলবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। সৌদি বাদশাহর সঙ্গে ভিডিও সংলাপে এবং সম্মেলনের বক্তৃতায় মাহাথির আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, কুয়ালালামপুর সম্মেলন অত বৃহৎ কিছু নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালচাল জানা কারোরই বুঝতে অসুবিধার কথা নয় যে, যখন সৌদি বাধার জন্য ওআইসি মুসলিমদের কোনো সমস্যাতেই শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ, তখন মালয়েশিয়া-ইরান-তুরস্কের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মুসলিম রাজনীতির নতুন মেরুকরণেরই আলামত।
সৌদি আরব ও আমিরাত কাশ্মীর ও উইঘুর সমস্যাকে ভারত ও চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে। সৌদি আরব তো জাতিসংঘে চিঠি লিখে উইঘুরদের বন্দিশিবিরে রাখার পক্ষে যুক্তিও দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে সৌদি আরব মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে বটে, কিন্তু অভিবাসী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে তাদের হৃদয় টলেনি। চীন-ভারতের সঙ্গে না-হয় উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য তো কাশ্মীর জ্বলন্ত সমস্যা। এ বিষয়ে কথা বলায় কুয়ালালামপুর সম্মেলন ছিল ইমরানের জন্য বড় সুযোগ। কিন্তু তার চেয়েও বড় হলো ক্ষমতা ধরে রাখার সংগ্রাম। পাকিস্তান সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সংকটে পড়া পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য সৌদি আরবের প্রতিশ্রুত সাহায্য জীবননালির মতো জরুরি। মালয়েশিয়া কিংবা তুরস্ক-ইরানের মতো সাহসী হওয়ার সামর্থ্য সামরিক, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও দেশটির নেই। উপরূন্তু বিরোধীরা তক্কে তক্কে আছে। মাহাথির ও এরদোয়ানের মতো গরম বক্তৃতা করার ইচ্ছা ইমরানের থাকলেও বাস্তবতা তাঁর বিপক্ষে।
কুয়ালালামপুর সম্মেলন এক দিক থেকে সফল। আরব ও বাইরের বিশ্বে সৌদি আরবের দাপট কমছে। ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরব হারছে, সিরিয়ায় আল আসাদ টিকে গেছে, ইরান সৌদি ও ইসরায়েলি সীমান্তের পাশে শক্তি সংহত করেছে। ইরাক ও লেবাননের গণআন্দোলনও ইরানপন্থীরা সামলে ফেলেছে। মুসলিম দুনিয়ার একচ্ছত্র নেতৃত্ব উপভোগ করার দিন সম্ভবত ফুরাচ্ছে সৌদি আরবের। আগেও তারা এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। ষাট-সত্তরের দশকে মিসরের গামাল আবদেল নাসেরের সরকার আরব জাতীয়তাবাদের ধ্বনি তুলে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন চাঙা করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি প্রভাব যেভাবে কমাতে চেয়েছিল। মাহাথির মোহাম্মদের উদ্যোগকেও সেভাবেই দেখছে তাঁর পক্ষের এবং বিপক্ষের শিবির। অনেকেই তাঁর মধ্যে বেদিশা মুসলিম দেশগুলির কাঙ্ক্ষিত নেতার আদল দেখতে চাইছেন। মাহাথিরের জোরের জায়গা হলো, তিনি একটি সফল অর্থনৈতিক বিপ্লবের রূপকার এবং আধুনিক মনস্ক অসাম্প্রদায়িক চিন্তার লোক।
কুয়ালালামপুর সম্মেলনে সৌদি বলয়ের নেতারা না এলেও ইরান-তুরস্কের নেতৃত্বে নতুন মেরুকরণ চাপা রাখা যায়নি। ইরান বা তুরস্ক বা মালয়েশিয়া বা কাতার যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, তার কারণ যার যার জাতীয় স্বার্থ। এসব দেশ কেবল তেলের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল নয়। তাছাড়া কাতার বাদে অন্যরা এক ধরনের গণতন্ত্রের চর্চাও করে আসছে। মাহাথির যতই বলুন কুয়ালালামপুর সম্মেলন কোনো নতুন মুসলিম জোটের প্রস্তুতি নয়, সৌদি আরবের শত্রুরা এক মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে। আগামী বছরের বিশ্ব রাজনীতিতে এই ঘটনার জের অবশ্যই থাকবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]