মাস্ক-গ্লাভসের বর্জ্য: নদী যেন গন্তব্য না হয়
প্রকৃতির সুশোভিত ও পল্লবিত রূপ ফিরে এসেছে করোনা মহামারির পথ বেয়ে। একদিকে মানুষ বিপর্যস্ত, অন্যদিকে প্রকৃতি উদ্ভাসিত। এ পৃথিবী এখন পাখপাখালির পৃথিবী, পোকামাকড়ের পৃথিবী, সবুজ বৃক্ষলতার পৃথিবী। আর মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই অসহায় মানুষের নিত্যসঙ্গী। করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এখন প্রয়োজন মাস্ক-গ্লাভস-স্যানিটাইজার। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মাস্ক-গ্লাভস-পিপিইর উৎপাদন চলছে। স্যানিটাইজারও উৎপাদিত হচ্ছে টনে টনে। কিন্তু ব্যবহারের পর এসব বর্জ্যের গন্তব্য কোথায়?
নিঃসন্দেহে পরিবেশঝুঁকির এ এক নতুন মাত্রা। এ মুহূর্তে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণাভিত্তিক দিকনির্দেশনা। এসব পুরোপুরি জৈব বর্জ্য নয়, যা পরিশোধন করে রূপান্তরযোগ্য। ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন এবং বিনষ্টের লক্ষ্যে আমাদের সুনির্দিষ্ট আইন আছে। ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বর্জ্য বিধিমালা-২০০৮’-এ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে।
প্রথমে বর্জ্য চিহ্নিত, তারপর বর্জ্যের শ্রেণিবিন্যাস এবং সবশেষে কোন প্রক্রিয়ায় বর্জ্য ডিসপোজাল, অর্থাৎ ধ্বংস, পোড়ানো বা পুঁতে ফেলা হবে, তা নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। এ কমিটিতে সিভিল সার্জনসহ বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি রয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কত উদাসীন ও দায়িত্বহীন!
একসময় রাজধানীর টনে টনে বর্জ্য পলিথিনের গন্তব্য ছিল বুড়িগঙ্গা। ড্রেজিং করে বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭-৮ ফুট স্তর পলিথিনের বর্জ্য উত্তোলন করে নদী দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর অর্থনৈতিক মূল্য বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু নদী তার হৃত প্রবাহ ফিরে পায়নি। করোনা মহামারি শিক্ষা দিয়েছে, মানুষের অর্থ লোলুপতা ও সীমাহীন ভোগবাদিতার করুণ পরিণতি কী হতে পারে! প্রকৃতিকে নিঃস্ব, রিক্ত ও বিপর্যস্ত করে আজ স্বয়ং মানুষই ক্লান্ত, নিঃস্ব ও অশ্রুসিক্ত। কী মর্মান্তিক বাস্তবতা! করোনা প্রমাণ করেছে, মানুষ এ বিশাল প্রকৃতির মালিক নয়, প্রকৃতির একটি অংশমাত্র।
বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি সবুজ প্রান্তর, নদ-নদী, পাহাড়-টিলা ও হাওর-বাঁওড়। পৃথিবীজুড়ে জীবন-জীবিকার জোগান নদীকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের শিরা-উপশিরা নদীর পানি দিয়ে। অথচ নদীমাতৃক বলে আমাদের যে অহংকার ছিল, তা এখন অতীত স্মৃতি। ষাটের দশকের সাড়ে ৭০০ নদী কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৩০টিতে। দূষণে দূষণে বিষাক্ত এবং দখলে দখলে ক্ষতবিক্ষত করেছি নদীগুলোকে। হৃৎপিণ্ডের মতোই নদীগুলোর রক্তনালিতে সৃষ্টি করেছি অসংখ্য ব্লক।
সম্প্রতি সরকারের নদী উদ্ধার অভিযান বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দেন, অর্থাৎ যেকোনো ক্ষতি থেকে রক্ষায় নদীর আইনগত অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু এখন করোনাসৃষ্ট কোটি কোটি মাস্কের বর্জ্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এক গবেষণায় জানা গেছে, গত ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ১ মাসে ১ হাজার ৫৯২ টন সার্জিক্যাল মাস্কের বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে।
এমনিতে কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি, মানসিক চাপ ও মৃত্যুর মিছিলে আতঙ্কিত বিশ্ববাসী। এর মধ্যে মাস্ক-গ্লাভসের বর্জ্য পরিবেশ-সংকটকে ঘনীভূত করছে। কোটি কোটি মানুষের ব্যবহার করা মাস্কগুলো বর্জ্য হিসেবে অবক্ষেপণ করা হবে কীভাবে? তবে কি ডাস্টবিন, নালা-নর্দমা পেরিয়ে অবশেষে সঞ্চিত হবে নদীগর্ভে? এ দেশে নদ-নদীই আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ বর্জ্যাগার! বর্জ্য মাস্ক নিয়ে কী সমস্যা হতে পারে, মাস্কের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এর সমাধান আমাদের বের করতে হবে। বর্জ্য লুকিয়ে রাখা যায় না, দূষণ কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না। এর প্রভাব ও অভিঘাত পরিবেশে পড়বেই। নাগরিকেরা যত্রতত্র বর্জ্য ফেলবে এবং ব্ল্যাকহোলের মতো সেগুলো নদীতে হারিয়ে যাবে, এটিই বাংলাদেশের পরিবেশগত বাস্তবতা। এ মুহূর্তে মাস্কের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, নগরী-মহানগরীর অলিগলি, ভবনের কোনা, নালা-নর্দমা মাস্কের বর্জ্যে একাকার হয়ে আছে। যেখানে রাজধানীর অধিকাংশ ড্রেন পলিথিন ব্যাগে জমাট বেঁধে থাকে, সেখানে বর্জ্য মাস্ক-গ্লাভস যোগ হয়ে কী বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, তা অকল্পনীয়।
যে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আমরা সুরক্ষিত মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই ব্যবহার করছি, সেসব উপাদানের কঠিন বর্জ্য যদি নদী, মাটি বা পানিদূষণের কারণ হয়, তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের! তথ্যানুসন্ধানে জেনেছি, ইংল্যান্ডে ব্যবহৃত মাস্ক পৃথক হলুদ বর্ণের চিহ্নিত ডাস্টবিনে ভরে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে স্যানিটাইজারে ব্যবহৃত কেমিক্যাল মূলত উদ্বায়ী বিধায় এর দূষণের প্রভাব খুব নগণ্য। প্রতিটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার, পুনর্চক্রায়ন এবং বিকল্প ব্যবহার পরিবেশ সুশাসনের অংশ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রধানত অনুশাসন তিনটি: বর্জ্য সংগ্রহ, বর্জ্য পৃথক্করণ এবং বর্জ্য নিষ্পত্তিকরণ। হাসপাতালে ব্যবহৃত সংক্রামক বর্জ্য হাসপাতালের নিজস্ব বর্জ্যাগারে রেখে বিনষ্ট করা উচিত। হাসপাতালের বাইরে নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু মানুষের ব্যবহৃত মাস্ক-গ্লাভস প্রকৃতই বিপজ্জনক, তাই বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে পুড়িয়ে ফেলার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বর্জ্য থেকে এ বর্জ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় পৃথক্করণ করতে হবেই। এমনকি ডাস্টবিনে বা ডাম্পিং স্টেশনে বেশি দিন রাখাও অনিরাপদ। এসব বর্জ্য টোকাইরা কুড়িয়ে নিলে আরও ভয়ংকর বিপদ। লোকালয় থেকে অনেক দূরে এগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
এসব কাজ ঠিকভাবে হয় কি না, তার কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এ দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের একার নয়। প্রতিদিন নিক্ষিপ্ত ও সংগৃহীত বর্জ্যের সঠিক পরিসংখ্যান রাখতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবশ্যই চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সিটি করপোরেশন/পৌরসভাগুলো বর্জ্য মাস্ক-পিপিই রাখার জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় এনে প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিএসআরের অর্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সদ্ব্যবহার করা উচিত। তবেই আক্ষরিক ও নৈতিক বিবেচনায় সিএসআরে অর্থ ব্যয় সার্থক হবে।
বাংলাদেশে মাস্ক-গ্লাভস ব্যবসায় জড়িত উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করব, এসব পণ্য উৎপাদনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রয়োগ করুন। পণ্যের ভোক্তাদের বোঝার উপায় নেই কোনটি পরিবেশবান্ধব এবং কোনটি পরিবেশ-ঘাতক। কারণ, মুনাফার উন্মাদনায় পৃথিবী এখন করপোরেট সাম্রাজ্যের শিকলে বন্দী। উৎপাদনের লক্ষ্যই এখন ব্যবসায়িক, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক-মানবিক হয়ে উঠতে পারেনি। এ যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা এবং পরিবেশ রক্ষা হতে হবে একসূত্রে গাঁথা। যে প্রকৃতি থেকে আহরণ করি আমরা এত সম্পদ, রস ও রসদ, সে প্রকৃতির প্রতি আমাদের কত নিষ্ঠুরতা ও আক্রোশ! পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। হাজার হাজার টেক্সটাইল ও ডাইংয়ের বিষাক্ত বর্জ্যে আমাদের নদীগুলোর অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যে নেমে যায়।
সাম্প্রতিক সাধারণ ছুটিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান বন্ধ ছিল। অথচ লকডাউনে শিল্পবর্জ্য নির্গমন হ্রাস পাওয়ায় বুড়িগঙ্গায় অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় পাঁচ মিলিগ্রামে পৌঁছেছে (প্রতি লিটারে প্রয়োজন ছয় মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন)। সরকারের পরিবেশ আইন সফল করতে হলে নাগরিকদের মননে ও চেতনায় পরিবেশবান্ধব হতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের মনোভাব ও আচরণে পরিবেশকে আমরা অবজ্ঞা করি অবলীলায়। জাতিগতভাবে আমাদের মননে ও মগজে আইন অমান্য করার বিষয়টি রয়েছে। ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে আমরা এখনো পরিবেশ-শিষ্টাচার আয়ত্ত করতে পারিনি। জরিমানা বা শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত মানুষ আইন মানতে চায় না। সমস্যাটি আমাদের মানসিক ও নৈতিক কিন্তু অভিঘাতে জর্জরিত হচ্ছে পরিবেশ।
একটি সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন সমাজের সূচকের পরিমাপে পরিবেশ রক্ষা অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারিনি। চলমান করোনা মহামারিতে যদি যুক্ত হয় বর্জ্যের মহামারি, তাহলে আমাদের পরিবেশ-অবক্ষয় পূর্ণ হবে ষোলোকলায়। সুতরাং পরিবেশ আইন ও নির্দেশনা এবং জনগণের আইন মান্যতা একই বিন্দুতে আনতে হবে।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
মহাপরিচালক
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর