মাসুদকে সবাই ভালো হয়ে যেতে বলে, কিন্তু মাসুদ আর ভালো হন না। সেই মাসুদ এখন মিরপুরের বিআরটিএ কার্যালয় থেকে প্রধান কার্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন (সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)। মাসুদ ভালো হয়েছেন কি না, তা জানা না গেলেও চাকরিতে যে তাঁর উন্নতি হয়েছে তা বোঝা যায়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ই-কমার্স জালিয়াতি, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক হামলা—সবকিছুর সূত্র পাওয়া সম্ভব।
তার আগে ভাইরাল হওয়া মাসুদের পরিচয় জানা যাক। চার বছর আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মিরপুরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয় পরিদর্শনে যান। সে সময় তিনি হুটহাট বিভিন্ন স্থান ও দপ্তর পরিদর্শন করতেন। অনিয়ম দেখলে শাসাতেন। সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের বহর সেসবের ভিডিও ফুটেজ প্রচার করতেন। সে রকম এক পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের সামনে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক মাসুদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘মাসুদের সঙ্গে দেখা হলেই আমি বলি “মাসুদ, তুমি ভালো হয়ে যাও।” কিন্তু সে এখনো পুরোপুরি ভালো হননি। মাসুদ দীর্ঘদিন বিআরটিএতে আছে। ব্যবহার ভালো, মধুর মতো। কিন্তু যা করার একটু ভেতরে-ভেতরে করে।’(সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)
যোগাযোগমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তখন নিজেই বলেছিলেন, ‘ সে এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি।’ ভালো না হওয়া মানে দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়া। তাহলে তাঁর শাস্তি হলো না কেন? নসিহতে কি কেউ ভালো হয়? বাড়িতে মা-বাবা, স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা, মঞ্চে নেতা, মসজিদের ইমাম, জনপ্রিয় বক্তা, মোটিভেশনাল স্পিকার—সবাই তো ভালো হয়ে যেতে বলছে। কিছু কি লাভ হয়েছে? সবখানেই কি খারাপ মানুষের প্রতাপ দেখা যায় না?
তবু সদুপদেশের কমতি নেই। সম্প্রতি ইভ্যালি ইত্যাদির বাণিজ্যিক জালিয়াতির পর মানুষের লোভ সংবরনের দিকে অনেক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। লেখালেখিতেও অনেক বলেছেন নিজেদের লোভ সংবরণ করতে হবে। পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তাও একই ধরনের উপদেশ দিয়েছেন।
আমরা দেখেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২০১৬ সালে হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলাকারী তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের খবরে বলা হয়েছে, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই তিনজন উপজেলার হরিপুর, পূর্বভাগ ও সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।’
সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় ঘৃণ্য ঘটনাগুলো ঘটল, সে বিষয়েও ফেসবুকে অসংখ্যজন যা বলছেন, তার সারমর্ম এটাই যে ‘অন্যায় কোরো না, ভালো হয়ে যাও’।
ভালো হয়ে যাও বললেও কেউ যেমন ভালো হয় না, তেমনি সম্প্রীতির ডাক দিলেই সম্প্রীতি আসে না। মাসুদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার যদি বিচার হতো, তিনি যদি শাস্তি পেতেন, তাহলে তিনি আপনা-আপনি কারাগারে ভালো জীবন যাপন করতেন। সব মাসুদই যদি নিরপেক্ষ বিচারে শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার ভয়ে থাকত, আর্থিক প্রতারণার আয়োজন যদি অঙ্কুরেই থামিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে হাজারো মানুষ সর্বস্বান্ত হতো না। যেখানে দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ, অসাধু কাজকে গোড়াতেই পুলিশ দিয়ে থামানো যেখানে দরকার ছিল, সেখানে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর সাধু হওয়ার উপদেশ দিয়ে লাভ কী? আমরা দেখেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২০১৬ সালে হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলাকারী তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণের খবরে বলা হয়েছে, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই তিনজন উপজেলার হরিপুর, পূর্বভাগ ও সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।’ এই হলো অবস্থা।
অপরাধীকে ভালো হতে বলার আর্তিটা অক্ষমের। কেননা, আহ্বান জানানো ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা তাদের থাকে না। কিন্তু যাঁরা নাকি দায়িত্বে অধিষ্ঠিত, যাঁদের ক্ষমতা রয়েছে বিচারের, ক্ষমতা রয়েছে প্রতিকারের, ক্ষমতা রয়েছে প্রতিরোধের, তাঁদের মুখ থেকে উপদেশের সাধুবাণী মানুষ শুনতে চায় না। মানুষ চায় তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। মানুষ ভরসা সৃষ্টিকারী দৃষ্টান্ত চায়, কথার প্রলেপ দিয়ে অপরাধীদের বিচারের ভার তাঁরা আড়াল করতে পারেন না।
ভালো হয়ে যাওয়ার উপদেশের মতোই আরেকটি হাওয়াই মিঠাই হলো অপরাধীদের পরিচয় বিভিন্ন বিশেষণে আড়াল করা। যেমন বলা হয় ‘দুষ্কৃতকারী’, বলা হয় ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’, বলা হয় ‘চক্রান্তকারী’ ইত্যাদি। দুষ্কৃতিটা কে করল, কাদের নিয়ে করল, মদদ দিল কারা, সেসব পরিষ্কার না করা মানে অপরাধীদের আড়াল করা। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কি সমাজের লোক, দেশের লোক? যদি হয়, তাহলে তাদের পরিচয় থাকবে, নামধাম থাকবে। আমাদের পুলিশ বাহিনী অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সক্ষম। ডিজিটাল প্রযুক্তি, সিসিটিভি ক্যামেরা, আড়ি পাতার ক্ষমতা; কী নেই রাষ্ট্রের হাতে? তার পরও অপরাধের হোতাদের পরিচয় নিয়ে কেন রহস্য জারি থাকবে? সেই অবসরে যে গুজবের বাঘ মানুষকে খেয়ে ফেলে! মনের বিষ মেশানো তির যে যার পছন্দের ভিলেনের দিকে ছুড়তে থাকে তখন। গুজব ও অস্পষ্টতা তখন জন্ম দেয় আরও অপরাধের।
ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান, আসন ও ব্যক্তির তরফ থেকে যাত্রার বিবেকের মতো ভালো উপদেশ মানুষ শুনতে চায় না। মানুষ চায় কাজ। এমন কাজ, যা সমাজকে, ব্যক্তিকে ও সম্প্রদায়কে আরও নিরাপদ করবে। তাদের সামনে উপদেশবাণী লেখা সিল্কের ঝালর দোলালে চোখে ধাঁধা লাগে।
কথায় বলে, চোরায় না শোনে ধর্মের বাণী। চোরার একমাত্র ভয় শাস্তির নিশ্চয়তা। ভালো হয়ে যাওয়ার উপদেশ কিংবা পরিচয় লুকিয়ে অদৃশ্য দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে বয়ান তাদের আরও উৎসাহিত করে। তারা বুঝতে পারে, যেহেতু উপদেশ দিচ্ছে, সেহেতু মারবে না, যেহেতু নাম নিচ্ছে না, সেহেতু ধরবে না।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]