যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের হঠাৎ সিদ্ধান্তটি মনে করিয়ে দেয় যে ওয়াশিংটনে কোনো সাধারণ সময় বিরাজ করছে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও কংগ্রেস রাশিয়া থেকে সৌদি আরব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জগুলো যখন চাপিয়ে দিচ্ছিল, তখন ট্রাম্প সিরিয়া নিয়ে এই গোপন পরিকল্পনা ফাঁদেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিদেশে মার্কিন ক্ষমতা কার্যকরভাবে সীমিত করে দিয়ে নিজ দেশে নির্বাহী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগামী ১০০ দিনে ২ হাজার মার্কিন সেনাকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও শত্রু উভয়কেই অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সময় ও যৌক্তিকতা নিয়ে সহজ কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেউ কেউ বলছেন, নিজ দেশে তাঁর যেসব আইনি ঝামেলা চলছে, তা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে বলছেন, গত সপ্তাহে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনে কথোপকথনের ফল এটি। অনেকে আবার বলছেন, সিরিয়ার সঙ্গে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের চুক্তি হয়েছে আর এ কারণেই এই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত।
এসব জল্পনাকল্পনা ছাড়াও ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প হয়তো সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এ কারণে নিয়েছেন যে সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীকে রাখার কোনো আর্থিক বা কৌশলগত মূল্য তিনি দেখছেন না। গত মার্চ মাসে ট্রাম্প এক সমাবেশে খাপছাড়াভাবেই ঘোষণা দেন, মার্কিন বাহিনী খুব শিগগির সিরিয়া থেকে বেরিয়ে আসছে। তখন পেন্টাগন ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কমান্ডার-ইন-চিফকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে সিরিয়ায় অবশ্যই মার্কিন বাহিনীকে থাকতে হবে। কিন্তু এপ্রিল মাসে তিনি মার্কিন সেনাদের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্তকে (আইএসআইএল) দমন করার জন্য ছয় মাস সময় দেন। চলতি মাসের গোড়ার দিকে মার্কিন সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) আইএসআইএল-নিয়ন্ত্রিত হাজিন শহর দখল করে। ট্রাম্প এখন মনে করেছেন যে মার্কিন সেনাদের যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে এবং এখন তাদের বাড়ি ফিরে আসা উচিত।
এই সিদ্ধান্ত এই ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা টিম থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। কয়েক মাস ধরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের নেতৃত্বে তাঁর প্রশাসনের রক্ষণশীল অংশ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীকে রাখার জন্য যে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, তা মনে হয় বিফলেই গেছে।
সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কারণে হোয়াইট হাউস ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান অনাস্থাকে আরও প্রসারিত করতে পারে, যা কিনা আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
যুদ্ধ এবং শান্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হোয়াইট হাউস সাধারণত ঘোষণা করে কংগ্রেস ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর। কিন্তু সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাতে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে এসব সংস্থা ও কংগ্রেসের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিভাজনকে স্পষ্ট করেছে। আর এ কারণে আগামী দিন, সপ্তাহ ও মাসগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে অনেক পদত্যাগের ঘোষণা আসতে পারে।
এটা উল্লেখ করা খুবই জরুরি যে সাত বছর ধরে সিরিয়া বিষয়ে মার্কিন নীতি নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে এবং ট্রাম্প হয়তো এর যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছেন। তুর্কি ও কুর্দিদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ উত্তর সিরিয়ার স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখেনি। এই দীর্ঘ সাত বছরে ওয়াশিংটন সিরিয়ার সঙ্গে না পেরেছে কোনো চুক্তি করতে, না পেরেছে সিরিয়ার ভেতরে মস্কোকে মোকাবিলা করতে, আর না করেছে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে কোনো বিনিয়োগ।
এখানে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সিরিয়ার ২ হাজার মার্কিন সেনার কোনো যৌক্তিক ভূমিকা ছিল না এবং তাদের প্রত্যাহার করার অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রয়োজন তখন সিরিয়ায় বিমান হামলা চালানোর ক্ষমতা হারাবে। কিন্তু সিরিয়ায় মার্কিন প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে এটি প্রত্যাহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে প্রয়োজনীয় শর্ত জুড়ে দেওয়া ছাড়াই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে সবচেয়ে যে খারাপ বিষয়টি হতে পারে, তা হলো তুরস্ক এবং কুর্দি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ।
যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়ায় কীভাবে থাকতে হবে, তার যেমন কোনো কৌশল ছিল না, এখন এটি পরিষ্কার যে তারা কীভাবে চলে যাবে, তারও কোনো কৌশল নেই।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান
জো ম্যাকারন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক