ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪৭টি দেশকে যে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) দিচ্ছে, তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৩ সালে। এরপর আসছে ১০ বছর মেয়াদি জিএসপি প্লাস। আগের জিএসপির তুলনায় বেশ কিছু কঠোর শর্ত পূরণ করে এই সুবিধা অর্জন করতে হবে। এ জন্য নানা উদ্যোগ ও যথেষ্ট প্রস্তুতি প্রয়োজন। হাতে সময় খুব বেশি নেই।
জিএসপির আওতায় এখন বাংলাদেশ ইউরোপের দেশগুলোতে অস্ত্র ছাড়া সব (এভরিথিং বাট আর্মস বা ইবিএ) পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এর সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারছে। ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের অর্ধেক। সামনের জিএসপি প্লাস সুবিধা ধরে রাখার বিষয়টি তাই বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনসে টরিঙ্ক ১০ জানুয়ারি ডেইলি স্টার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিএসপি প্লাসের সুযোগ পাওয়ার শর্তগুলোসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জিএসপি প্লাস পেতে হলে বাংলাদেশকে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি এবং শ্রমসংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন মেনে চলতে হবে। আগের ইবিএ সুবিধার চেয়ে জিএসপি প্লাসের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোতে বেশি জোর দেওয়া হবে। তবে মানবাধিকার ও শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়নের শর্তের পাশাপাশি পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ও গুরুত্ব পাবে। এ নতুন শর্তগুলো বাণিজ্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে জিএসপি প্লাস প্যাকেজটি অনেক বিস্তৃত এবং বাংলাদেশকে নানা ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি করতে হবে। বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আইএলও কনভেনশনের অনেক দিক বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে এবং সই করেছে। এটা ভালো, কিন্তু এগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অগ্রগতি করতে হবে। বাংলাদেশের শ্রম আইন পরিবর্তন করা হয়েছে, একে আমরা সাধুবাদ জানাই, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ লেবার রাইটস রোডম্যাপে অগ্রগতি করেছে। আমরা সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ যে নড়েচড়ে বসেছে, তা বোঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ছয় বছর মেয়াদি একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। এ ধরনের সময়নির্ভর একটি পরিকল্পনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে চাওয়া হয়েছিল। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার খবর (১১ জানুয়ারি) বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া সময়সীমা মেনে নভেম্বর মাসে এ রোডম্যাপ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এ খসড়া রোডম্যাপে বাংলাদেশ এ বছরের জুনের মধ্যে শ্রমিকের ন্যূনতম বয়স ও ফোর্সড লেবারসংক্রান্ত আইএলওর প্রটোকল অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইএলওর বিধান অনুযায়ী ১৫ বছরের নিচে সবাই শিশু এবং তাদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে এখন এই বয়স ১৪। তবে শ্রম আইন ও বিধি সংশোধন এবং ইপিজেড শ্রমবিধি কার্যকর করার জন্য সরকার ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে। এ ছাড়া রোডম্যাপে এই সময়ে বাস্তবায়নের জন্য আরও অনেক প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
মানবাধিকার ইস্যুতে অবরোধ আরোপ নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় কাউন্সিল গত ৭ ডিসেম্বর একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার অবরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত এবং এ ব্যাপারে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বা এর সহযোগী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেকোনো ব্যক্তি বা পুরো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করতে পারবে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য আইএলও ঘোষিত শ্রমমান এই সময়ের মধ্যে পুরোপুরি নিশ্চিত করা কতটুকু সম্ভব, সেই সংশয় রয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু হয়েছে, এটা আশার কথা। একই সঙ্গে এটা বিবেচনায় রাখতে হবে যে জিএসপি প্লাসের শর্ত বিবেচনায় নিয়ে অন্য দেশগুলোও তৎপর হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম আইএলওর গাইডলাইন মেনে শ্রম আইন পরিবর্তন করেছে। ১ জানুয়ারি থেকে সেই আইন কার্যকর হয়েছে। এর ফলে ভিয়েতনামের শ্রম আইন আইএলও এবং ইইউর মানে চলে এসেছে।
এবার জিএসপি প্লাসের অপর গুরুত্বপূর্ণ শর্ত মানবাধিকার প্রসঙ্গে আসা যাক। ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টরিঙ্ক বাংলাদেশের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে আমাদের কঠোর সমালোচনা রয়েছে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এবং ইউরোপভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তরফে আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশ্নের মুখোমুখি হই। যখন সাংবাদিকেরা আটক হন, তখন আমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও মানবাধিকার সংলাপের মাধ্যমে এসব বিষয় নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের একটি ভালো আলোচনা হয়েছে। আমরা ফলোআপ বৈঠকের অপেক্ষা করছি।
শুধু জিএসপি প্লাস সুবিধার শর্ত নয়, মানবাধিকার ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সামগ্রিকভাবে আগের চেয়ে কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছে। মানবাধিকার ইস্যুতে অবরোধ আরোপ নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় কাউন্সিল গত ৭ ডিসেম্বর একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার অবরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত এবং এ ব্যাপারে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বা এর সহযোগী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেকোনো ব্যক্তি বা পুরো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করতে পারবে। বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটুক, তার বিরুদ্ধে ইইউ ব্যবস্থা নিতে চায়।
ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টরিঙ্ক ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানসংক্রান্ত মহাপরিচালকের কার্যালয় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা মূল্যায়ন করছে, বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে কি না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি এবং ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেল বলেছেন, বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটুক না কেন, নতুন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে অবরোধ আরোপের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। এখন দেশভিত্তিক অবরোধ আরোপের যে বিধান রয়েছে, সেখানে নতুন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের দায়মুক্তি রোধের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উন্নয়ন সহযোগিতা বা বাণিজ্যসুবিধা স্থগিত করার পথ ধরবে।
ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টরিঙ্ক ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানসংক্রান্ত মহাপরিচালকের কার্যালয় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা মূল্যায়ন করছে, বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে কি না।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, বাংলাদেশে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ,সমালোচকদের আটক ও গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপের ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে করোনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে (প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি)।
১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এইচআরডব্লিউর বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশটিতে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আটকের ঘটনা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো অন্যায় থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। সরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের ভিন্নমত থামিয়ে দিয়েছে এবং কোভিড মোকাবিলায় সরকারের নানা ব্যর্থতা নিয়ে যারাই কথা বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।
জিএসপি প্লাসের শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করে কি না, সেটা যখন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তখন এইচআরডব্লিউর যে প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেল, তাতে এটা নিশ্চিত যে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বড় ধরনের উন্নতি করতে হবে। ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টরিঙ্ক বলেছেন, ইবিএ এমন একটি উপহার, যা কোটা ও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়। ২০২৩ সালের পর নতুন জিএসপি প্লাসের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো এটা নিশ্চিত করতে চায় যে সেখানে পণ্য প্রবেশের আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ন্যূনতম শ্রম আইন ও মানবাধিকার মেনে চলা হয়েছে।
দেশের শ্রমমান উন্নয়নের জন্য আইএলও ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাইডলাইন মেনে রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য তেমন রোডম্যাপ কই? শুধু শ্রমমান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ও এর রোডম্যাপ দিয়ে তো জিএসপি প্লাস মিলবে না।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক