করোনা মহামারির সময়ে যখন মানবতার দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিবিজড়িত বরিশালে মানবতার বাজার খুলেছিলেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী এবং তাঁর সহযোগীরা। তিনি রাজনীতি করেন। পেশায় একজন চিকিৎসক। ২০১৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
সেই মনীষা বরিশালের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অত্যন্ত নিকটজন। যেখানে খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষ বিপদে পড়েন সেখানে তিনি ছুটে যান, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরুতে মনীষা বেশ কিছু ইজিবাইককে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তরিত করেন। যাদের নিজের গাড়ি নেই বা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের বিনা পয়সায় হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন তিনি এই অ্যাম্বুলেন্সে। এ জন্য এর নাম রাখা হয় গরিবের অ্যাম্বুলেন্স।
এরপর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষ তথা দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ইজিবাইকচালক, হকার গৃহকর্মীরা বেকার হয়ে পড়েন। মনীষা ও তাঁর দল বাসদের উদ্যোগে খোলা হয় মানবতার বাজার। দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি শহরের বিত্তবানদের সহায়তায় তাঁরা প্রতিদিন কয়েক শ লোকের হাতে চাল, ডাল, তেল, নুনসহ খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন। গরিব মানুষগুলো শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাস করেন। তাঁদের ঘরে ঘরে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।
এ কারণে উদ্যোক্তারা অমৃত লাল দে কলেজের মাঠটি বেছে নেন। করোনার কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাদের মাঠটি ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। গরিব মানুষ জানতে পারেন কোথায় গেলে খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যাবে। এভাবে গত বছর মনীষা ও তাঁর সহযোগীরা ২০ হাজার মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছেন।
চলতি বছর লকডাউনের প্রেক্ষাপটে ফের তাঁরা অমৃতলাল দে কলেজ মাঠে মানবতার বাজার চালু করেন। কিন্তু দুই দিন না যেতেই কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, মানবতার বাজারের জন্য তাদের মাঠটি ব্যবহার করতে দেওয়া সম্ভব নয়। কেন দেওয়া যাবে না তারা ব্যাখ্যা দেননি।
কিন্তু বরিশালের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, রাজনৈতিক চাপের কারণেই কলেজ কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। যাঁরা ভেবেছেন মানবতার বাজার খুলে মনীষা চক্রবর্তী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যাচ্ছেন, তাঁরাই তাঁদের রাজনীতির জন্য হুমকি মনে করেছেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছেন।
তাঁরা আরও জানালেন, করোনাকালে বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল মানুষের সহায়তায় উল্লেখ করার মতো কোনো কর্মসূচিই নেয়নি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গত বছর কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও এবার তারাও নীরব। অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় মনীষা ও তাঁর সহযোগীদের মানবতার বাজার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
একটি ভালো কাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় আরেকটি ভালো কাজ দিয়ে। কিন্তু বরিশালের প্রভাবশালী মহল অন্যের ভালো কাজ আটকে দিয়ে, মানুষের চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব প্রমাণ করতে চায়।
এর মাধ্যমে তারা নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ করেনি, হতদরিদ্র মানুষগুলোর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতাও দেখিয়েছে। মাতৃভাষাকে যারা ভালো বাসে না তাদের সম্পর্কে মধ্যযুগের বাঙালি কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন, যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
কবির কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, যেই কুচক্রীরা গরিব মানুষের তৈরি বাজার বন্ধ করে দিতে নানা চক্রান্ত আঁটছেন, তাহাদেরও ‘জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ মনে হচ্ছে আমরা আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করছি।
অমৃতলাল দে কলেজে মানবতার বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে মনীষা চক্রবর্তী বলেছিলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর ৬ মে বরিশাল নগরের অমৃত লাল দে কলেজ মাঠে গত বছরের মতো মানবতার বাজার পরিচালনা শুরু করি। ২ দিনে এই মানবতার বাজার থেকে ৫ শতাধিক শ্রমজীবী ও দুস্থ মানুষের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, আলু, চিনি, সেমাই, সবজিসহ ১০ ধরনের নিত্যপণ্য বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় দুই দিন পর শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই কলেজের কর্তৃপক্ষ কলেজ মাঠে মানবতার বাজার পরিচালনা করার বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করে এবং এটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে আমাদের কাছে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা। কিন্তু ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী মহল এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ভালো কাজ বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে পরিণত করেছে।
অমৃতলাল দে কলেজ মাঠ ব্যবহার করতে না দেওয়ার পর উদ্যোক্তারা আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগযোগ করেন। প্রথমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ আগ্রহ দেখায়। পরে পিছিয়ে যায়। আবার দূরবর্তী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজি হলেও সেখানে গরিব মানুষ যেতে পারবে না।
এরপর মনীষা ও তাঁর সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মাঠ না পাওয়া গেলে ভ্যানে করেই মানবতার বাজার চালু করবেন। রোববার টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম চালডালসহ সারি সারি ভ্যান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে সহায়তাপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। একজন করে সামনে আসছেন, উদ্যোক্তারা তাঁর হাতে খাবার সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন। টেলিফোনে মনীষা চক্রবর্তীর কাছে জানতে চাইলাম, আপনাদের এই মানবতার বাজার কত দিন চলবে? তাঁর জবাব, যত দিন লকডাউন বা বিধিনিষেধ থাকবে, তত দিন তাঁরা বাজার চালু রাখবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লকডাউনের কারণে কাজ হারানো হতদরিদ্র লোকজনকে সহায়তার জন্য সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বরিশালের প্রভাবশালী গোষ্ঠী সেই মানবিক সহায়তার কাজে বাধা দিচ্ছে, সরকার কি একবার খোঁজ নিয়ে দেখবে, এই দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে কারা জড়িত? কারা মানবতার বাজার বন্ধ করে দিতে দানবীয় চক্রান্ত এঁটেছিল?
সোহরাব হাসান প্রথম আলো যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]