পৃথিবীতে যত মারাত্মক সমস্যা রয়েছে, তার শীর্ষে রয়েছে মাদকাসক্তি। একটি পরিবারে বা সমাজে অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিই যথেষ্ট। বাংলাদেশ পৃথিবীর দুটি বৃহৎ মাদক পাচার রুটের মধ্যে পড়েছে—গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড) এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান)। এ কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি মাদকাসক্ত ব্যক্তি রয়েছে। আইসিডিডিআরবির ‘জার্নাল অব হেলথ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন (জেএইচপিএন)’–এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। তবে অনেকের দাবি, এটি ৭০ লাখ। আবার অনেকের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কোটির কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। জেএইচপিএনের তথ্যমতে আসক্তদের ৭৯.৪ শতাংশ পুরুষ, ২০.৬ শতাংশ নারী; বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদক নেয় ৮৫.৭ শতাংশ; মাদক গ্রহণকারীদের ৫৬.১ শতাংশ বেকার বা ছাত্র এবং ৯৫.৪ শতাংশ ধূমপায়ী।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ড্রাগ ইনটেলিজেন্স সেন্টারের (এনডিআইসি) জরিপে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের জন্য উৎপাদন ঘাটতি বছরে ১২ হাজার কোটি ডলার; অপরাধসংক্রান্ত ব্যয় ৬১০ কোটি ডলার; ফৌজদারি বিচার খাতে ব্যয় ৫৬০ কোটি ডলার। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের জন্য ক্ষতি হয় প্রতিবছর ৮২ হাজার কোটি ডলার। অ্যারেস্টি ড্রাগ এবিউজ মনিটরিং প্রোগ্রামের (এডিএম-২) মতে, গ্রেপ্তারকৃত অপরাধীদের ৬৩-৮৫ শতাংশ মাদকসেবী। ব্রিটিশ পুলিশের তথ্যেও জানা যায়, সে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ অপরাধী মাদকসেবী।
কোনো এলাকায় ৫ শতাংশ মানুষ এইচআইভি পজিটিভ হলে মহামারি বলা হয়। অথচ বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে শিরায় ইনজেকশন নেয়, এমন মাদকাসক্তের মধ্যে এ হার ছিল ১১ শতাংশ। এখন এ হার আরও বেড়েছে। একে বলে ‘কনসেনট্রেটেড এপিডেমিক’, যা দেশের জন্য এক অশনিসংকেত। মাদকাসক্তির জন্য শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, নৈতিক, পারিবারিক ক্ষয়ক্ষতি ও যন্ত্রণার দীর্ঘ তালিকা তো রয়েছেই। কোনো পরিবারে একজন মাদকাসক্ত থাকলে সে পরিবারে নরক নেমে আসে।
মাদক পাচার, সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। প্রচলিত পন্থায় সফল না হয়ে সরকার এখন বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। মাদক নির্মূলে যেকোনো পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে এ রকম পদক্ষেপে মানবাধিকার বা আইনের যাতে লঙ্ঘন না হয়, তা দেখতে হবে। মাদক নির্মূলে প্রয়োজন এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, সক্ষমতা, বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে তোলা। স্থায়ীভাবে ওই অপরাধীদের দমন করে রাখা ও ‘ভয়ের’ মধ্যে রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে পরিবার ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ–আলোচনা করতে হবে, তাদের দীর্ঘক্ষণ একাকী রাখা যাবে না। সন্তানদের সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করার পাশাপাশি পারিবারিক ‘নিয়ম-রীতি’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যালয়গুলোও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে যা করণীয়: শিক্ষার্থীদের ক্রোধ, আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণ শেখানো; সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শেখানো; ভালোভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে তোলা; মাদকসহ যেকোনো অবাঞ্ছিত আহ্বানকে ‘না’ বলতে শেখানো; মাদকবিরোধী মনোভাব তৈরি; সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখানো।
মাদকাসক্তি একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’। তাই এটির মূলোৎপাটন করতে হলে প্রবল সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। বর্তমানে সমাজে যে সাড়া জেগেছে, একে পুঁজি করে এ আন্দোলনকে আরও জোরালো করতে হবে ও সামনে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে বলতে চাই, মাদককে ‘না’ বলতে দ্বিধা করবে না; তোমার হয়ে অন্যকে সিদ্ধান্ত নিতে দেবে না; মন্দ বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভালো বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়ে দাও; মা-বাবা ও মুরব্বিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংযোগ দৃঢ় করো; পারিবারিক ‘নিয়ম-রীতি’ মেনে চলো; মাদক ছাড়াই জীবনকে উপভোগ করতে শেখো; সংগীত, খেলা, শিল্পকলা, সমাজসেবায় নিয়োজিত থাকো; মাদক নিয়ে যে মিথ্যা ভুল ধারণা, মিথ রয়েছে, সেগুলো জানো।
মাদকাসক্তি একটি ক্রনিক রিলাপসিং ডিসঅর্ডার (ডায়াবেটিসের মতো)। এটি আসলে মস্তিষ্কের অসুখ। তাই মাদকাসক্তদের বহুমুখী, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হবে। মাদকাসক্তদের ওষুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাও দিতে হবে। যেমন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাউন্সেলিং; পুনঃ আসক্তি প্রতিরোধ প্রোগ্রাম; গ্রুপ থেরাপি/থেরাপিউটিক কমিউনিটি; মোটিভেশন এনহেন্সমেন্ট থেরাপি ইত্যাদি। পরিশেষে বলব, মাদকাসক্তি একটি ‘প্রতিরোধযোগ্য’ ব্যাধি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি সম্মিলিত প্রয়াস নেয়, তাহলে সমাজকে অবশ্যই মাদকমুক্ত রাখা সম্ভব।
মো. তাজুল ইসলাম মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল