২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মাথাপিছু আয় ও অধরা উন্নয়ন

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ হিসাবের বোধগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সাধারণ মানুষও এ বিষয়ে সন্দিহান। রসিকতা করে কেউ কেউ বলছেন, যে আয় জনগণের মাথার পিছে থাকে বলে জনগণ কোনো দিন দেখেন না, তাকে মাথাপিছু আয় বলে। কেন মানুষ এসব বলাবলি করছেন, আমার সাম্প্রতিক সন্দ্বীপযাত্রার অভিজ্ঞতার আলোকে তা আলোচনা করব।

দীর্ঘ তিন বছর গ্রামের বাড়ি যাইনি। হিউস্টন থেকে ছোট মামা এসেছেন, তিনি ৩৭ বছর গ্রামে যাননি। আমাকে বললেন, সঙ্গে চলো। অমিক্রনের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলাম।

যাত্রার বিড়ম্বনা

রাজধানী ঢাকা, এমনকি চট্টগ্রাম শহর থেকেও সরাসরি সন্দ্বীপ যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে কুমিরা ঘাট, তারপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ। মামার হাতে সময় কম। ঠিক হয় বিমানে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে সড়কপথে কুমিরা ঘাট যাব। সস্তার জন্য আগেভাগেই টিকিট কিনি। সকালের ফ্লাইট নিই যাতে করে গ্রামে বেশি সময় কাটাতে পারি। যাওয়ার আগের দিন চাচাতো ভাইয়ের ফোন, ‘তোমরা জোয়ার–ভাটার খোঁজ নিয়ে কুমিরা ঘাট থেকে যাত্রা করো।’ তিনি ও ভাবি আগেভাগেই সন্দ্বীপ পৌঁছেছেন আমাদের দেখভাল করার জন্য। আমি বললাম, ‘কেন, কী হয়েছে?’ ভাটার সময় রওনা দিয়ে তিনি মহাবিপদে পড়েছিলেন। স্পিডবোট তাঁদের কাদায় নামিয়ে দেয়। সেখানে ভাবির পা কাদায় আটকে যায়। আমার রসিক ভাইটি বলেন, ‘কী শরমের কথা, ঘাটভর্তি লোকের সামনে আমাকে তোমার ভাবির পা ধরে কাদা থেকে তুলতে হয়েছে!’ তাঁর দুঃখ, ভাবির কষ্টের জন্য নয়, সবার সামনে ভাবির পায়ে হাত দেওয়ায় তাঁর পৌরুষে লেগেছে!

আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ফার্স্ট ফ্লাইটে সকাল ৯টার মধ্যে চট্টগ্রাম পৌঁছে, সরাসরি ১০টায় কুমিরা ঘাট হয়ে স্পিডবোটে বেলা ১১টা নাগাদ বাড়ি পোঁছাব। খবর নিয়ে জানলাম, বেলা দুইটার আগে জোয়ার নয়। তাই চট্টগ্রামে অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করে বেলা দুইটায় কুমিরা ঘাটে পৌঁছালাম। সেখানে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ জেটি। কেউ রিকশা–ভ্যানে, যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাঁরা ব্যাগ–বস্তা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমরা স্পিডবোটে উঠি ছাউনি ও লাইফ জ্যাকেটবিহীন যাত্রার জন্য। পথে পূর্ণ জোয়ারের প্রচণ্ড ঢেউ। আমার সঙ্গের নারীদের কাউকে কাউকে দোয়া-দরুদ পড়তে শুনি। যাক নির্বিবাদে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট পৌঁছাই। জেটি বেয়ে ওপরে উঠে আবার এক কিলোমিটার হেঁটে ডাঙায়। জোয়ার থাকায় কাদায় নামতে হয়নি। ঘাট থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ১২ কিলোমিটার। সিএনজিতে যেতে ফাঁকা রাস্তায় এক ঘণ্টা লাগল। কংক্রিটের রাস্তার অনেকটাই ভাঙা। গর্ত থেকে সিএনজি ওঠানামার সময় হাড়ে ব্যথা লাগে। বিকেল চারটায় বাড়ি পৌঁছে পূর্বপুরুষদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে যাত্রার বিড়ম্বনা ভুলে যাই। মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে।

বলাবাহুল্য, শীতকাল হচ্ছে সন্দ্বীপে যাতায়াতের জন্য সুদিন। বর্ষাকালে যাত্রীদের দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। অথচ ষাটের দশকেও চট্টগ্রাম নিয়াজ স্টেডিয়ামের দক্ষিণে হেলিপ্যাড থেকে উড়ে ১৫ মিনিটে সন্দ্বীপ যাওয়া যেত। চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে বড় স্টিমারে গাঙচিলের উড়াল দেখতে দেখতে সন্দ্বীপ যাওয়া যেত। সাত কোটি টাকা ব্যয়ে আগে নির্মিত জেটির পাশে ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি জেটি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সন্দ্বীপের মানুষের নিরাপদ জলকাদামুক্ত, সব আবহাওয়ায় যাতায়াতের ন্যূনতম প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আর্থিক ব্যয় ও উন্নয়ন যে সমার্থক নয়, এখানে তা স্পষ্ট।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সজ্জন বলে পরিচিত। তিনি বদ্বীপ পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর কি একবার সময় হবে মোহনার এসব বিপন্ন দ্বীপ দেখার? জনবিনিয়োগের খরচ লাভ বিশ্লেষণ বলে, যেখানে খরচ কম লাভ বেশি সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম একটি সংযোগ সেতুতে জনবিনিয়োগ করলে তা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের কারণে বহুগুণে ফিরে আসবে। তা ছাড়া এখানে তিনি জনবিনিয়োগের অপচয়ও প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। সর্বোপরি সন্দ্বীপের মানুষগুলোও মানুষ, দেশের নাগরিক। কেবল মাথাপিছু আয়ের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হওয়া নয়, নিরাপদ যাত্রা, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও দুবেলা দুমুঠো খাবার পাওয়ার অধিকার তাঁদের আছে।

সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ–সংযোগ

সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সংবাদ হলো, নভেম্বর ২০১৮ সালে সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ–সংযোগ প্রদান। কেবল গৃহস্থালিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎ, ব্যবহৃত হচ্ছে ফ্রিজ ও এসি। তিন বছরের বেশি হলো, এখনো কোনো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। যাতায়াতের সমস্যার সুরাহা না হলে সন্দ্বীপে কোনো বিনিয়োগ হবে না। অথচ সন্দ্বীপের যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বিপুলসংখ্যক মানুষ এখানে বিনিয়োগ করতে মুখিয়ে আছেন।

বিদ্যুৎ–সংযোগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ প্রচুর। জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হরিশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতে বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য। আমি তাঁকে বলি, ক্ষমতাসীন দল আপনাদের রাজনৈতিক মিত্র। আপনি আপনার নেতাদের বলেন। হায় রাজনীতি! বিদ্যুৎ–সংযোগ দিতেও বিএনপি, জাতীয় পার্টি—এসব বাছবিচার চলছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ‘জিতেছেন’। আশা করি হরিশপুরবাসী এবার বিদ্যুৎ–সংযোগ পাবেন। আর সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ আছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারি কর্মচারী—উভয়ের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন

বেহাল স্বাস্থ্য খাত

ঘাট থেকে বের হয়েই, খানিকটা দূরে হাতের বাঁয়ে ডাঙায় পরিত্যক্ত পড়ে আছে অনেক ব্যয়ে সংগৃহীত ‘সি-অ্যাম্বুলেন্স’। অথচ দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে জীবন বাঁচানোর জন্য এ ধরনের বাহন অপরিহার্য। কালাপানিয়ায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিনতলা ভবনটি বাইরে থেকে পরিত্যক্ত মনে হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সপ্তাহে তিন দিন একজন চিকিৎসক ও একজন কম্পাউন্ডার রোগী দেখার কথা থাকলেও এক মাস ধরে তা বন্ধ চিকিৎসক ও সহকারীর অভাবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা অন্য কোথাও করোনা অতিমারি বিষয়ে সচেতনতামূলক কোনো পোস্টার চোখে পড়েনি। অথচ শুনেছি, আমাদের সন্দ্বীপ অবস্থানকালেই ইউএনও এবং সাংসদের পরিবার করোনায় আক্রান্ত।

রেমিট্যান্সের টাকায় উঠছে দালানকোঠা

ঘাট থেকে নেমেই, অনেকগুলো ইটভাটা (যা আগে দেখিনি) আর নামকরা একটি ইস্পাত কোম্পানির রডের ঢাউস বিজ্ঞাপন দেখে বোঝা যায় ভেতরের নির্মাণযজ্ঞের কথা। আমার নানাবাড়িতেও এ রকম ঘর তুলছেন একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। দেখলাম বাইরের দেয়ালে টাইলস লাগাচ্ছেন। এসব বাড়িঘরে থাকার কেউ নেই, যা মৌলভীবাজারে লন্ডনিদের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত এসব বাড়িঘর জাতীয় উৎপাদনে যোগ হবে ঠিকই, কিন্তু তা কার উপকারে আসবে?

আরও পড়ুন

বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমি

গতবার দেখেছিলাম, মাঠের পর মাঠ অনাবাদি জমি, ফসল, শাকসবজি কিছুই নেই। এবার দেখলাম, শাকসবজির চাষ কিছুটা বেড়েছে। এক কেজি মোটা চালের দাম ৩৫ টাকা। ১০ কেজি চাল ঢাকায় পাঠাতে স্থানীয় পরিবহন ও কুরিয়ার খরচ ৪০০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজি ৪০ টাকা; যা পণ্যমূল্যের চেয়ে বেশি। তাই সবকিছুই বাইরে থেকে আসে। সবকিছুরই অগ্নিমূল্য। একজন কৃষক কীভাবে আর কেনই–বা ফসল ফলাবেন? একজন দিনমজুরের মজুরি ৬০০ টাকা, তা–ও প্রতিদিন কাজ থাকে না। যাঁদের বাড়িতে রেমিট্যান্স আসে না, তাঁরা কীভাবে দিনাতিপাত করেন, তাঁদের দুঃখের রাত কবে পোহাবে, কে জানে!

নাগরিক উদ্যোগ

সন্দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তর উপকূলজুড়ে জেগে উঠেছে বিপুল পরিমাণ চর, যার আয়তন কয়েক হাজার থেকে লাখ একর। নতুন চর নদীভাঙা, সর্বস্বান্ত মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে এবং একসঙ্গে শঙ্কাও। এখানকার মানুষ তাঁদের ভেঙে যাওয়া ন্যামস্তি ইউনিয়নের জায়গায় জেগে ওঠা ভাসানচরসহ স্বর্ণদ্বীপ ও উড়ির চরের অংশবিশেষ সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত না করায় ক্ষুব্ধ। এবার তাই তাঁরা সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে, যাতে করে নতুন জেগে ওঠা চর তাঁদের হাতছাড়া না হয়, সে জন্য নিজ ব্যয়ে কালাপানিয়া-বাটাজোড়া সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে দিয়েছেন। পূর্বপুরুষের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সজ্জন বলে পরিচিত। তিনি বদ্বীপ পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর কি একবার সময় হবে মোহনার এসব বিপন্ন দ্বীপ দেখার? জনবিনিয়োগের খরচ লাভ বিশ্লেষণ বলে, যেখানে খরচ কম লাভ বেশি সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম একটি সংযোগ সেতুতে জনবিনিয়োগ করলে তা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের কারণে বহুগুণে ফিরে আসবে। তা ছাড়া এখানে তিনি জনবিনিয়োগের অপচয়ও প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। সর্বোপরি সন্দ্বীপের মানুষগুলোও মানুষ, দেশের নাগরিক। কেবল মাথাপিছু আয়ের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হওয়া নয়, নিরাপদ যাত্রা, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও দুবেলা দুমুঠো খাবার পাওয়ার অধিকার তাঁদের আছে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক