এত দিন দেশে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ‘মাজার’ ছিল। রাজনীতির মাঠে নতুন আসা রাজনীতিকেরাও সেই পথে হাঁটলেন। তাঁরাও কোনো কিছুর আনুষ্ঠানিক সূচনার একটা ‘মঞ্চ’ খুঁজে পেলেন।
রাজনীতির ময়দানের নতুন খেলোয়াড় গণ অধিকার পরিষদ আগামী দিনে তাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপটি যে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সমাধিস্থল থেকে নেবে, দেশীয় রাজনীতির অঙ্কের হিসাব তা-ই বলছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাবাবেগ উসকে ভোটের পালে হাওয়া টানার কায়দাটি অতি ব্যবহারে জীর্ণ। অগ্রজদের দেখেশুনে যতটা শেখায় অনুজদের ‘কুশলী’ মনে হচ্ছে, তাতে ভোটের ‘কাটাকুটি খেলা’য় তাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত। কিন্তু ‘রাজনীতি’র কী হবে?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যে রাজনীতি, বহুদিন সে দেশ থেকে ‘নিখোঁজ’। তার আনুষ্ঠানিক শেষকৃত্যানুষ্ঠান কেউ করেনি বটে, তবে তার ‘বেঁচে থাকা’ নিয়ে নিঃসংশয় হতে দরকার শতভাগ আশাভরা বুকের পাটা। রাজনীতির নামে যা চলছে হরে-দরে, সাধারণ মানুষের কাছে তা ‘ভোট’ ও ‘দাপট’-এর বেশি কিছু নয়। যাঁর দাপট যত বেশি, ভোটের মাঠে জয় তাঁর তত কুক্ষিগত। কথাটিকে ছড়া কেটে এভাবেও বলা যায়, ‘যাঁর যত দাপট, তাঁর তত ভোট’। আজকের দিনের শিশুটিও বোঝে, যাঁর হাতে ক্ষমতা, দাপট তাঁর; জনসমর্থন এখন আর কাউকে বলীয়ান করে না। তাই ‘জনমত’ শব্দটি টিকে আছে অভিধানে, আর জনগণের গুরুত্ব আছে কেবল সংবিধানে। দেশের জল-হাওয়া-মাটিতে এসবের কোনো জায়গা নেই!
তবে ইতিহাসের শিক্ষা মানলে বলতে হয়, যুগে যুগে তরুণ-যুবাদের বুকের পাটাতনে জায়গা পেয়েছে দেশ, দেশের মানুষ। তাঁদের রক্তে খেলা করে ভবিষ্যৎ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। তাই স্বভাবত নবীনদের আগমনে রাজনীতির ‘শুদ্ধিকরণ’ প্রক্রিয়া চালুর একটা আশাবাদ তৈরি হয় বৈকি। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ‘গণ অধিকার পরিষদ’ কি সেই বার্তার বাহক নয়? তবে তাদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যেভাবে নতুন সামাজিক অহিংস শক্তির উন্মেষ ঘটিয়েছিল, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ময়দানে তা কতটা কার্যকর থাকতে পারবে, আছে সে প্রশ্নও। রাজনীতি এখন ততটাই সমাজবিমুখ, যতটা সে ক্ষমতামুখী। তাই আদর্শের রাজনীতির তেলের সঙ্গে মাঠের ওরফে ভোটের রাজনীতির জল কতটা মিশ খাবে, তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত হবে না নুরুলদের।
কৃষিতে উন্নতি করেছেন, বিদেশে গিয়ে গতরে খেটেছেন, নতুন নতুন ব্যবসায় জড়িয়েছেন। এখনো মধ্যবিত্তের মর্যাদা না পেলেও গ্রামীণ অর্থনীতির কান্ডারি এই কয়েক কোটি মানুষের ‘মুখপাত্র’ হয়ে ওঠেনি এখনো কেউ। নুরুলসহ তাঁর সহযোগীরা মূলত গ্রাম-মফস্বল-প্রান্তিক জনপদ থেকে উঠে আসা এই শ্রেণিভুক্ত।
গত এক-দেড় দশকে দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ মাথার ওপর মোটামুটি আচ্ছাদন গড়তে পেরেছেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর অবস্থায় এসেছেন, গোছাতে পেরেছেন কিছুটা সঞ্চয়ও। কৃষিতে উন্নতি করেছেন, বিদেশে গিয়ে গতরে খেটেছেন, নতুন নতুন ব্যবসায় জড়িয়েছেন। এখনো মধ্যবিত্তের মর্যাদা না পেলেও গ্রামীণ অর্থনীতির কান্ডারি এই কয়েক কোটি মানুষের ‘মুখপাত্র’ হয়ে ওঠেনি এখনো কেউ। নুরুলসহ তাঁর সহযোগীরা মূলত গ্রাম-মফস্বল-প্রান্তিক জনপদ থেকে উঠে আসা এই শ্রেণিভুক্ত।
অন্যদিকে অতীত গৌরবের চর্বিতচর্বণে এখন ততটা না মজলেও পুরোনো মধ্যবিত্তদের সামনে দুই মূলধারার রাজনীতির বাইরে ‘বিকল্প’ কিছু নিয়ে কেউ হাজির হতে পারেননি। তাই এক দিনের ‘গণতন্ত্র’ উপভোগেও তাঁরা উৎসাহ হারিয়েছেন; অবশ্য সেই সুযোগও এখন অবসিত। এই শূন্যতায় যখন সাম্প্রদায়িকতার চাষবাস ক্ষমতাসীনদের ঘরে ‘ফসল’ তুলে দিচ্ছে, বিরোধীদের আছড়াতে রাষ্ট্র যখন তার সব কটি কল ও কাঠির এস্তেমালে ক্রমশ দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে উঠেছে, সেই আবহে গণ অধিকার পরিষদের উত্থানের ‘টাইমিং’ যথাযথ। কিন্তু জনগণের অপরাপর অংশের সঙ্গে তাঁরা ‘টাই’ বাঁধবে কীভাবে?
সংকটটা কেবল এখানে নয়, রাজনীতির ক্ষেত্রবিচারেও। রাজনীতি এখন একটা বড় অংশের, বিশেষত তরুণদের একাংশের ‘জীবিকা’ হয়ে উঠেছে। তাঁদের না আছে চাকরিবাকরি পাওয়ার মতো শিক্ষা, না আছে ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো পুঁজি। মূলত নুরুলদের শ্রেণিভুক্ত এই তরুণদের সঙ্গে নিম্নবিত্তের দিশাহীন তরুণেরাই রাজনীতির কান্ডারিদের ‘কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের ভরসা। তাঁরা ক্ষমতার খুঁটি বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টাতে দ্বিধান্বিত নন, বরং একেই তাঁরা ‘বাস্তবসম্মত’ জ্ঞান করেন। এর বাইরে রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজেদের জীবিকাকে ‘পোক্ত’ করে নিয়ে নুন-লঙ্কা, চাল-ডালের ব্যবসায়ী থেকে ভূমির কারবারি হয়ে বসে আছেন।
স্বাভাবিকভাবেই এসব স্বার্থান্বেষী মহল-গোষ্ঠী ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদারিতে ব্যস্ত। চারদিকে গড়ে উঠেছে নানা সিন্ডিকেট, লুটেরা শ্রেণি, ‘কমিশন’ এজেন্ট। এই মধুখেকোরা ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে সার্বক্ষণিক ভিড় করে থাকছে। তাদের ভিড়ে আড়ালে পড়ে আছে ‘সব ক্ষমতার উৎস’ জনগণ। দ্রব্যের অগ্নিমূল্যে যাঁদের হাতে ফোসকা পড়ে, ন্যায্য সেবা-পরিষেবা পেতে যাঁদের উৎকোচ দিতে হয়, গণপরিবহনে অন্যায্য ভাড়া দিতে যাঁরা বাধ্য হন, তাঁরা ভোটাধিকারেও সমান অপাঙ্ক্তেয়। বৃহত্তর এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো কৃষিতে সাফল্যগাথার রচয়িতারাও তাঁদের রক্ত জল করা শ্রমে উৎপাদিত ফসলের যেমন ন্যায্য দাম পান না, তেমনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে তাঁদের সমর্থনের দিনও গত। দেশের গর্ব তৈরি পোশাক খাতের লাখো শ্রমিকের ‘ম্লান জীবন’, অপ্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য খাতের শ্রমজীবীরা কোথাও কোনো আলোচনায় নেই।
ব্রাত্য করে রাখা এই সব মানুষের সসম্মান স্বস্থান দিতে পারে ‘রাজনীতি’। নুরুলরা কি সেই রাজনীতির উপাসক? তাঁদের দল কি ন্যায্য-অন্যায্য সব সুবিধাভোগী এলিটদের বিপরীতে গণমানুষের মুখপাত্র হয়ে উঠবে, গত শতকে যেমনটা হয়ে উঠেছিল কৃষক-প্রজা পার্টি?
গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে অন্যতম ভাসানীর বন্দনায় নুরুলরা মুখর হবেন, এটা বোধগম্য। কিন্তু তাঁর সমাধিস্থলকে ‘মাজার’-এর মাহাত্ম্যদানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ‘ফটোকপি’ হিসেবেই নিজেদের উপস্থাপিত করেছেন তাঁরা।
এরই মধ্যে বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন না করতে বিরোধী সব দলকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন নুরুল হক। অর্থাৎ ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে থাকা ডান-বামনির্বিশেষে সবার সঙ্গে হাত মেলাতে তিনি প্রস্তুত। এটি কি ভোটের ‘কাটাকুটি খেলা’র সূচনা?
হাসান ইমাম সাংবাদিক