বাংলাদেশ নবজাতক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিতে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হ্রাস-সম্পর্কিত জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি #৪) অর্জন করেছে ২০১০ সালে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ১২ অথবা এর নিচে কমিয়ে আনতে হবে। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৮। নবজাতক মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য।
বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ৩.২) অর্জনের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম একটি প্রধান কারণ, অপরিণত জন্মজনিত জটিলতা। ১৯ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যুর জন্য এটা দায়ী। যেসব শিশু গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করে, তাদের অপরিণত নবজাতক বলা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ অপরিণত নবজাতকের জন্ম হয় এবং তাদের মধ্যে মারা যায় প্রায় ১৭ হাজার শিশু (দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ ২০১৯; ৭(১): ই৩৭-ই ৪৬)। অপরিণত নবজাতকের মা-বাবা অথবা তার পরিচর্যাকারীর ত্বকের সঙ্গে অপরিণত নবজাতকের ত্বকের সংস্পর্শে রেখে পরিচর্যা দেওয়া হলে তা অনেক নবজাতকের জীবন বাঁচতে পারে। এই সহজ কৌশল ক্যাঙারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
যেসব নবজাতকের জন্ম ওজন ২,৫০০ গ্রামের কম, তারা শারীরিকভাবে অপরিণত হয়। তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে বেশি। অপরিণত জন্মের প্রধান কারণ হলো কিশোরী বয়সে সন্তান জন্মদান, অপুষ্টি, সংক্রমণ, উচ্চ রক্তচাপ, পরপর গর্ভধারণের মধ্যে কম সময়ের ব্যবধান, ইত্যাদি। অপরিণত নবজাতকের প্রচলিত সেবা পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল। এর সফলতা নির্ভর করে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবাকর্মী এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সার্বক্ষণিক অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামাদির সরবরাহের ওপর। নবজাতকের প্রচলিত সেবা পদ্ধতিতে, অপরিণত জন্ম বা অসুস্থ নবজাতকের হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিউ) মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। অপরিণত নবজাতকের বিশেষ সেবা দেওয়ার জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিউ) রয়েছে উন্নত যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবাকর্মী। গবেষণা থেকে জানা যায়, কেএমসি অপরিণত নবজাতকের পরিচর্যার জন্য একটি নিরাপদ, কার্যকর এবং সুলভ পদ্ধতি। অপরিণত এবং কম জন্ম ওজনের (এলবিডব্লিউ) শিশুদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সাহায্য করে এটি। কেএমসির মাধ্যমে নবজাতক নিরবচ্ছিন্নভাবে মায়ের অথবা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বুকের সরাসরি সংস্পর্শে থাকে, যা তার শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এ পদ্ধতিতে নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ হয়। তারা দ্রুত বেড়ে ওঠে, সংক্রমণ থেকে সহজে রক্ষা পায় এবং মা-বাবার সঙ্গে দ্রুত দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করা যাক। লক্ষ্মীপুর জেলা হাসপাতালে আমার সঙ্গে আকলিমা আক্তার ও তাঁর স্বামী ফাহাদের দেখা হয়। আকলিমা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মাত্র ১,৭০০ গ্রাম ওজনের একটি নবজাতকের জন্ম দেন। লক্ষ্মীপুর জেলা হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট শিশুটিকে পরীক্ষা করে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের কেএমসি ইউনিটে পাঠান। সেখানে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সহায়তায় আকলিমা ও তাঁর স্বামী কেএমসি প্রটোকল অনুযায়ী কীভাবে নবজাতকের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয় তা শেখেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরবর্তী তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আকলিমা এবং তাঁর স্বামী সাপ্তাহিক ফলোআপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ চালিয়ে যান। এ সময়ের মধ্যে তাঁদের সন্তানের ওজন ২,৫০০ গ্রামে পৌঁছে।
আকলিমার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই, সঠিকভাবে কেএমসি সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু থেকে একটি নবজাতককে কীভাবে বাঁচানো যায়। এ জন্য জেলা হাসপাতালের সুপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের ধন্যবাদ। এই স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সেবাদানের দক্ষতা অর্জনে এবং কেএমসি সেবা প্রদানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামাদির সার্বক্ষণিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় প্রদান করেছে ইউএসএআইডির ‘মামণি’ মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন প্রকল্প (মামণি এমএনসিএসপি)। এটি সেভ দ্য চিলড্রেন এবং কনসোর্টিয়াম অংশীদারদের দ্বারা বাস্তবায়িত। এ ছাড়া দেশব্যাপী বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে কেএমসি সেবা প্রসারের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল নিউ বর্ন হেলথ এবং আইএমসিআই প্রোগ্রামকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ২৫০টি কেএমসি ইউনিট রয়েছে, যা দেশব্যাপী প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
যদিও বাংলাদেশে কেএমসি প্রসারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশব্যাপী এর প্রসারের ক্ষেত্রে এখনো বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো: প্রশিক্ষিত নার্সদের ঘন ঘন কর্মস্থল পরিবর্তন, কেএমসির জন্য মনোনীত ফোকাল পারসনকে হাসপাতালের অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা, ইত্যাদি। অন্যদিকে মা এবং তাঁর পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় বাচ্চাকে কেএমসি সেবা দেওয়া, বেশি ছোট বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানো, ফলোআপ সেবা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। সফলভাবে কেএমসি সেবা প্রদানের জন্য এসব প্রতিবন্ধকতার সমাধান করা অতীব জরুরি।
এ বছর বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘জিরো সেপারেশন-অ্যাক্ট নাও! কিপ প্যারেন্টস অ্যান্ড বেবিস বর্ন টু সুন টুগেদার’। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জন্মের প্রথম ঘণ্টা এবং দিনগুলোতে মা-বাবা এবং নবজাতকের একসঙ্গে থাকার বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই বছরের প্রতিপাদ্যের বিষয়টি কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি নবজাতকের সঙ্গে মা-বাবার সংস্পর্শ এবং তাঁদের মধ্যে পারিবারিক সময় কাটানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। অপরিণত, কম জন্ম ওজন বা খুব অসুস্থ শিশুদের জন্য পরিবারকেন্দ্রিক সেবা বিশ্বব্যাপী মহামারির সময়েও যে নিরাপদ এবং অত্যাবশ্যকীয়– সেটাই এই বছরের প্রতিপাদ্যের মূল বার্তা।
কেএমসি একটি কার্যকরী, সহজেই প্রদানযোগ্য ও সুলভ সেবা পদ্ধতি। অপরিণত এবং কম ওজনে জন্ম নেওয়া শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে এটি সহায়তা করে। কেএমসির মাধ্যমে সেবা প্রদান পদ্ধতি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য সরকারের প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেএমসিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের নবজাতক কর্মপরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের কর্মসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও অপরিণত জন্ম এবং অপরিণত জন্মজনিত জটিলতার কারণে বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় আনতে এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। তবু আমরা বিশ্বাস করি কেএমসি সেবা পদ্ধতি বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ডা. উম্মে সালমা জাহান মীনা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ইউএসএআইডি–এর ‘মামনি’ মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন প্রকল্প (মামনি এমএনসিএসপি) এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স টু কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক–এর চিফ অফ পার্টি হিসাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন