যখন কোথাও কোনো বিপর্যয় ঘটে এবং মানুষ গণহারে হতাহত হয়, তখন সেই খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে যে মৌলিক নীতি মানতে হয়, সেটি হলো ভিকটিম বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনদের বিষয়ে সংবেদনশীল থাকতে হয়। এ বিষয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমকে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। সাধারণত তারা নিজেদের দেশে এই নীতি অনুসরণ করে, কিন্তু অ-পশ্চিমা সমাজের কোনো ঘটনা তুলে ধরার সময় সেই সংবেদনশীলতার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
ভারতে কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের খবর প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের এ দ্বিচারিতা আরও একবার উন্মোচিত হলো। তারা লাগাতারভাবে ভারতে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের লাশ ও এ–সংক্রান্ত আতঙ্ক–জাগানিয়া দৃশ্যের ছবি প্রচার ও প্রকাশ করে যাচ্ছে। অথচ ঠিক একই ধরনের বিপর্যয় তাদের দেশে ঘটলে সাধারণত এভাবে খবর ও ছবি প্রকাশ করে না। এ পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গেছে, তার প্রায় অর্ধেকই ইউরোপ ও আমেরিকায়। অথচ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম সেসব দেশের করোনা–সংশ্লিষ্ট ছবি সেভাবে প্রচার করেনি, যেভাবে এখন তারা ভারতের ছবি ছড়াচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যখন মহামারি তুঙ্গে উঠেছিল, তখন হাসপাতালের জরুরি ওয়ার্ডে ডাক্তার ও নার্সরা কীভাবে রোগীদের চাপ সামলাচ্ছেন, তা টেলিভিশনের পর্দায় দেখানোর জন্য কোনো সাংবাদিক সেখানে জোর করে ঢুকবেন—এটি অকল্পনীয় ছিল। অথচ ভারতে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকেরা, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরা ক্রুরা বলা যায় জোর করে হাসপাতালগুলোতে ঢুকে পড়ছেন। এটি যে মানুষের জীবন–মরণের প্রশ্ন, তা তাঁরা বিবেচনায় আনছেন না। টেলিভিশনগুলো করোনায় প্রাণ হারানো মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং স্বজনদের আহাজারির ছবি অবলীলায় প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে স্বজন হারানো মানুষের ব্যক্তিগত মর্মপীড়াকে পশ্চিমা দর্শকদের দর্শনীয় বিষয় বানিয়ে ছাড়ছে।
ঠিক একই ধরনের বিয়োগান্ত পরিস্থিতি যখন নিজেদের দেশে ঘটে, তখন ঠিক এ মিডিয়া আউটলেটগুলোই সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউইয়র্ক সিটিতে যখন কোভিড-১৯ সর্বোচ্চ মাত্রায় হানা দিয়েছিল ও অসংখ্য মানুষ মরছিল, তখন সেখানকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরতে কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠের গাছের সারির ‘স্যানিটাইজড’ ছবি প্রকাশ করেছিল। অন্যদিকে ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট করার সময় তারা শ্মশানের সারি সারি জ্বলন্ত চিতা আর এখানে–সেখানে পড়ে থাকা লাশের গা শিউরে ওঠা ছবি অবলীলায় প্রকাশ করে যাচ্ছে। সেই ছবি সারা পৃথিবীতে সব মানুষের নজরে পড়ছে।
ভারতীয়দের চিতার আগুন পশ্চিমাদের উপন্যাস, ম্যাগাজিন ও পেইন্টিংয়ের ক্ল্যাসিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। সে অনুযায়ী চিতায় দাহ করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার হিন্দু ঐতিহ্যের বিষয়ে পশ্চিমা দর্শকদের যে কৌতূহল রয়েছে, তা নিবৃত্ত করার মানসে পশ্চিমা মিডিয়া আউটলেটগুলো গণচিতার ছবি সম্প্রচার করছে (অবশ্য যদিও এ পরিবেশবান্ধব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পশ্চিমেও দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে)। এভাবে খবর ও ছবি প্রকাশে যে সাধারণ ভারতীয়দের ব্যক্তিগত নিভৃতির লঙ্ঘন হয় এবং ভারতের একান্ত বিষয় উন্মোচন করে দেশটিকে অসম্মান করা হয়, তা যেন সেই আউটলেটগুলো ভুলে যায়।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো এই প্রথম যে বিদেশের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে অসংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছে, তা নয়। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনাজনিত বিপর্যয়ের সময় এই সংবাদমাধ্যমগুলো একই আচরণ করেছিল। তারা সে সময় মানুষের জীবনের চেয়ে পারমাণবিক বিকিরণ দুর্ঘটনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খবর সম্প্রচার করছিল। এই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের চিরাচরিত সাংস্কৃতিক ও বর্ণবাদী স্বভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে থাকা জাপানি কর্মীদের, ‘পারমাণবিক সামুরাই’ এবং ‘আত্মঘাতী মিশনের পরমাণু নিনজা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
বাস্তবতা হলো ফুকুশিমায় পারমাণবিক রেডিয়েশন লিক হওয়ার পরপরই সেখান থেকে এক লাখ লোক সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সে সুবাদে রেডিয়েশনজনিত কারণে কেউ মারা যায়নি। কিন্তু তারপরও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ওই ঘটনাকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে পরিবেশন করেছিল। এ অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশের কারণে ফুকুশিমার অনেক দূরের নৌবন্দরগুলোতেও বিদেশি জাহাজ ভিড়ছিল না এবং অনেক দেশ টোকিও ও আশপাশ থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিয়েছিল।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো একইভাবে আফ্রিকার বিষয়ে প্রবল অন্যায় আচরণ করে। তাদের চোখে আফ্রিকায় সারা বছরই মহাদুর্যোগ লেগে থাকে। এ কারণেই আফ্রিকার খবরগুলোতে খুবই কদাচিৎ সেখানকার মানুষের আনন্দপূর্ণ ও হাস্যোজ্জ্বল ছবি প্রকাশ করতে দেখা যায়।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণে গিনিয়া, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে মোট ১১ হাজার ৩২৫ জন লোক মারা গিয়েছিল। অর্থাৎ এ দুই বছরে তিন দেশ মিলে যে প্রাণহানি হয়েছিল, তা মাত্র তিন মাসেই কোভিড-১৯-এ যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে।
এই ইবোলা মহামারির খবর প্রকাশ করতে গিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে শববাহী ব্যাগ ও পশ্চিম আফ্রিকানদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ঐতিহ্যগত প্রক্রিয়া দেখাচ্ছিল।
২০১৫ সালে ফিচার ফটোগ্রাফি বিভাগে একজন ফ্রিল্যান্স সংবাদ-আলোকচিত্রী পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস–এর হয়ে তিনি পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশের শেষকৃত্য করা ব্যক্তিদের সঙ্গে থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের দুঃখ, মৃত্যু এবং দুর্দশার ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবির ওপরই তাঁকে পুলিৎজার দেওয়া হয়েছিল।
লক্ষণীয় হলো, পশ্চিমা বিশ্বে মহামারিতে এত মানুষ মারা গেল, কিন্তু তা নিয়ে তোলা কোনো ছবি ২০২০ সালের পুলিৎজার পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায়ও স্থান পায়নি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে নিহত আমেরিকান সেনার লাশের ছবি কদাচিৎ এলেও আফগান, ইরাকি ও অন্য অ-পশ্চিমা দেশের সেনাদের লাশের ছবি প্রকাশ অতি সাধারণ ঘটনা।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর এই দ্বিমুখী নীতি বিশ্ব গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সাংবাদিকের দায়িত্ব হলো তথ্য সরবরাহ করা, সেই তথ্যকে অতিরঞ্জিত করে কিংবা কমিয়ে–বাড়িয়ে পরিবেশন করা নয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক