মশা বনাম মেয়র

কিছুদিন পরপর আমাদের ফুলার রোডে হেলিকপ্টার চালানোর মতো শব্দ হয়। উঁকি মারলে দেখা যায় মুখে ত্যানা প্যাঁচানো একটা মানুষ, হাতে মেশিনগানের মতো কিছু। সেখান দিয়ে তীব্র বেগে সাদা বাষ্প ছিটিয়ে একাকার করে দিচ্ছে সে ঝোপঝাড়। সাদা বাষ্পটা নাকি মশার ওষুধ। এটা দেওয়ার পর মশা কিছু মরতে পারে হয়তো। তবে বেশির ভাগই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে ঢুকে তিনতলা-চারতলা বাসায়। অসীম বিরক্তি নিয়ে আমরা তাই পটাপট দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। ভাবি এমন কামান দাগানোর পর মশা মরছে না কেন!

মশার ভয়ে আমরা অ্যারোসল আর মশা মারা চায়নিজ ব্যাট কিনি, বাচ্চাদের হাত-পায়ে লাগাই মশা বিকর্ষণের ওষুধ, গরমের রাতে বাসায় ঘুমাই মশারি দিয়ে। কিন্তু তবু কাজ হয় না খুব একটা। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় কারও কারও ডেঙ্গু হওয়ার খবর শুনি এবারও। আমরা সমাজের সুবিধাভোগী মানুষ। আমাদের এখানেই এই অবস্থা—এটা ভেবে ভেবে রাগ হতো। সেই রাগ হাস্যকর হয়ে যায় আমাদের চেয়ে বহুগুণে ওজনদার অর্থমন্ত্রীর খবর শুনে। অর্থমন্ত্রীকে তাঁর কাজে পরিকল্পনা কমিশনে যেতে হয়। কিন্তু তিনি ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি আর যাবেন না সেখানে মশার উৎপাতের কারণে। মশার কামড়ে তাঁর ডেঙ্গু হয়েছিল কিছুদিন আগে, তারও আগে চিকুনগুনিয়া। পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার আর সাহস নেই তাঁর।

ভাবি, এই যদি হয় সরকারের একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ অফিসের অবস্থা, তাহলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মশাবাহিত রোগ কী ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করেছে? ডেঙ্গুতে এ বছর এখন পর্যন্ত এ দেশে মারা গেছে ২২ জন। অবস্থার ভয়াবহতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি পর্যন্ত তাঁর উদ্বেগ জানিয়েছেন ঢাকা সফরে এসে। অথচ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমানো কোনো কঠিন কাজ নয়। এ জন্য এডিস মশা মারতে হয়, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হয়। এ কাজ করার জন্য মশক নিবারণী সংস্থা নামে বহু পুরোনো একটি দপ্তর আছে, আছে আরও বেশ কয়েকটা অফিস, এদের মাথার ওপর আছে সিটি করপোরেশন।

জনগণকে আরও বাড়তি সেবা দেওয়ার জন্য বছর কয়েক আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভেঙে দুটো করপোরেশন করা হয়। নগরের দুই দিকে আছে এদের বিশাল অফিস, শত শত কর্মী বাহিনী, উদ্যমী বয়সের দুজন প্রায় তরুণ মেয়র। গত বছর ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের সময় আমি নিজে দক্ষিণের মেয়রকে বলতে শুনেছি যে আগামী বছর (অর্থাৎ ২০১৯ সালে) ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন তাঁরা। অথচ এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ। গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছিল ১ হাজার ৩২২ জন। এ বছর এপ্রিল থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে হাসপাতালে এসেছে ৪ হাজার ৫৪৯ জন। প্রতিদিন এতে আক্রান্ত হচ্ছে গড়ে দেড় শ জন মানুষ। গত বছরের তুলনায় এবার মৃত্যুহারও বেশি।

হাসপাতালে আসার তথ্য থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমিত হিসাব হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। আগামী দুমাসে ডেঙ্গুর উর্বর সময়ে সংখ্যা বাড়তে পারে আরও অনেক বেশি।

প্রশ্ন উঠছে, কী করছে তাহলে সিটি করপোরেশন দুটো? এর উত্তরে আমরা যা জানছি তা ভয়াবহ, শোচনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য।

২.
ঢাকার সিটি করপোরেশন দুটো কী কী করেছে, কোথায় গলদ তা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করে যাচ্ছে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকা। আমি শুধু এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক তুলে ধরছি।

এক: মশা মারার জন্য দুটো সিটি করপোরেশনের বাজেট একত্রে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এর সিংহভাগ ব্যয় হয় মশার ওষুধ কিনতে। তবু নাকি এ ওষুধ অপর্যাপ্ত। করপোরেশনগুলোতে নতুন অন্তর্ভুক্ত করা ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৫টি। সেখানে ওষুধ ছিটানোর জন্য বরাদ্দ নেই। ঢাকার বাইরে দেশের অনেক অঞ্চলে ওষুধ ছিটানোর মতো কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই।

দুই: সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, সেটিও নিম্নমানের ও অকার্যকর। গত বছর মাঠপর্যায়ের একটি ব্যাপক গবেষণার পর সিটি করপোরেশন দুটোকে জানানো হয়েছিল যে তার ছিটানো ওষুধে এডিস মশা মারা যাচ্ছে না। উত্তর ঢাকার মেয়র মাত্র এ বছর ৭ জুলাই জানিয়েছেন যে নিম্নমানের কারণে তাঁরা আর উল্লিখিত ওষুধ ব্যবহার করছেন না। অথচ একই ওষুধ এখনো ব্যবহার করে যাচ্ছে দক্ষিণের সিটি করপোরেশন।

তিন: উত্তর সিটি করপোরেশন এখন ব্যস্ত নতুন ওই ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার কাজে, আর দক্ষিণ ভাবছে নতুন ওষুধ আমদানির কথা, যা সম্পন্ন করতে করতে লেগে যাবে আরও দু-তিন মাস। অথচ আগামী এই দু-তিন মাসই ডেঙ্গুর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়।

চার: ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি এমনকি এতে মৃত ব্যক্তির সঠিক পরিসংখ্যান জানানোর সদিচ্ছা বা সামর্থ্য নেই সরকারের।

এসব তথ্য জেনে সবার মনে প্রশ্ন আসার কথা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ববোধ নিয়ে। ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের তৃতীয় তফসিলে এর ২৮ ধরনের কাজের উল্লেখ আছে। তবে সাধারণভাবে মানুষ সিটি করপোরেশনকে চেনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা এবং মশা নিবারণীর মতো জনস্বাস্থ্যমূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এ তিনটি কাজের মধ্যে শেষ দুটোতেই সিটি করপোরেশনগুলোর ব্যর্থতার পরিচয় হাতেনাতে পাচ্ছে মানুষ।

সড়কে অনন্ত খনন, খানাখন্দক মেরামতে অনীহা আর বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে এডিসসহ অন্যান্য মশার প্রজননক্ষেত্র এ বছরও অবারিত রয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ছে এরা। অথচ মশা নিবারণের প্রস্তুতি দূরের কথা, এত বছর পরও মশা মারার লাগসই ওষুধ কী হবে, তা নির্ধারণেও ঢাকার সিটি করপোরেশনগুলো ব্যর্থ হয়েছে।

৩.
সিটি করপোরেশনগুলোর এই চরম দায়িত্বহীনতার কারণ কী, এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। হয়তো সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির ঘাটতি এ জন্য দায়ী। যেমন: করপোরেশনের মেয়রকে অপসারিত করতে নির্বাচিত কাউন্সিলদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দরকার। মেয়রের জবাবদিহি রয়েছে জনগণের কাছেও। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণ তাকে পরাজিত করে তার ব্যর্থতার শাস্তি দিতে পারে।

কিন্তু নির্বাচনব্যবস্থায় মারাত্মক ঘাটতি থাকলে এসব ভয় আর থাকে না কারও। বছরের পর বছর মশা নিবারণ, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, পুকুর-ডোবা পরিষ্কারের কাজ করা যায় নামকাওয়াস্তে। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এদের অফিসের দুর্নীতি অনুসন্ধানে তেমন আগ্রহী হয় না বলে নিম্নমানের ওষুধ কেনার মতো বিষয়ে দুর্নীতি হচ্ছে কি না, এ নিয়ে চিন্তা থাকারও কারণ থাকে না।

আদালতে শাস্তির ভয় নেই, সহকর্মীদের কাছে অনাস্থার ভয় নেই, জনগণের কাছে বিতাড়িত হওয়ার ভয় নেই। কিন্তু তাই বলে কি নিজস্ব বিবেক নেই রাজধানীর দুই মেয়রের? তাঁদের একজন স্বনামধন্য সাবেক মেয়রের সন্তান, আরেকজন বহুল প্রশংসিত একজন মেয়রের উত্তরাধিকারী। সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা নিজেরাই কারও পিতা, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু। তাঁরা এ দেশের সন্তান। নিজের স্বজন, নিজের বন্ধু, নিজের দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা কি আরেকটু আন্তরিক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর পরিশ্রমী হতে পারেন?

মশা বনাম মেয়রের লড়াইয়ে মেয়রদের জিততে হবে। এটা শুধু লজ্জা না, নিদারুণ পরিতাপেরও বিষয় যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে মশাবাহিত এক আদিম রোগে এভাবে ভুগছে একটি দেশের মানুষ।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক