দীর্ঘ ১০ বছর আন্দোলনের পর অবশেষে মমতা জয় করে নিয়েছেন সিঙ্গুর। তুলেও নিয়েছেন এই আন্দোলনের ফসল। প্রথমে রাজ্যপাটে অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ। আর দ্বিতীয়ত, সিঙ্গুর আন্দোলনকারীদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁদের জমি। দীর্ঘ ১০ বছর লড়াইয়ের পর তাই মমতা পশ্চিমবঙ্গের একচ্ছত্র নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার টাটাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই রাজ্যে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য। টাটাও সম্মত হয়েছিল এই রাজ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তার ন্যানো গাড়ি নির্মাণের জন্য একটি কারখানা গড়তে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেদিন সিঙ্গুরের ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে টাটার হাতে তুলে দিয়েছিল। টাটাও শুরু করেছিল গাড়ির কারখানা নির্মাণের কাজ। কিন্তু আপত্তি তোলেন এই ৯৯৭ একর জমির অন্তত ৪০০ একর জমির মালিকেরা। তাঁরা দাবি তোলেন, না কিছুতেই তাঁরা তাঁদের জমি তুলে দেবেন না টাটার হাতে। শুরু হয় আন্দোলন। হাল ধরেন মমতা। সঙ্গে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। রাজ্যব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। মমতা নাছোড়বান্দা, ‘না কিছুতেই এই জমি দেওয়া যাবে না টাটাকে। মানি না রাজ্য সরকারের জমি অধিগ্রহণকে। ফিরিয়ে দিতে হবে এই জমি কৃষকদের।’ তাই এ জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মমতা একটানা ২৬ দিন অনশন করেন সিঙ্গুরে। কলকাতার ধর্মতলার সমাবেশে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা টাটার পণ্য বর্জনের ডাক দেন। কর্মীরা সভামঞ্চে টাটার পণ্য পুড়িয়ে নষ্ট করে টাটাকে এ বার্তা দেন, এই রাজ্যে টাটার ঠাঁই নেই।
অন্যদিকে সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ির কারখানা নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে থাকে। নির্মাণ করা হয় বহু কাঠামো। কিন্তু মমতার তীব্র আন্দোলনের মুখে টাটার তৎকালীন কর্ণধার রতন টাটা ঘোষণা দেন, তারা সিঙ্গুরে আর ন্যানো গাড়ির কারখানা করবেন না। এই কারখানা সরিয়ে নিয়ে যান গুজরাটের সানন্দে।
এদিকে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে প্রথম মামলা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। রায় যায় টাটার পক্ষে। মামলা ওঠে সুপ্রিম কোর্টে। সেই মামলার রায় হয় গত ৩১ আগস্ট। সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে জানিয়ে দেন, বামফ্রন্ট আমলে ২০০৬ সালে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ ছিল অবৈধ। তাই সব জমি ফিরিয়ে দিতে হবে কৃষকদের। শুরু হয়ে যায় তৃণমূলের বিজয় উৎসব। মমতা সিঙ্গুর বিজয় করে তাঁর প্রতিপক্ষ টাটা গোষ্ঠীকে ফের পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে বিনিয়োগের ডাক দেন। বলেন, ‘আসুন আপনারা। আরও জমি আছে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে আপনারা শিল্প গড়ুন। গাড়ির কারখানা গড়ুন।’
এর আগে মমতা মাদার তেরেসার সন্ত হওয়ার দিন ছুটে গিয়েছিলেন ভ্যাটিকান সিটিতে। সেখান থেকে জার্মানির মিউনিখে। মিউনিখে তিনি একটি বৈঠক করেন দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের সঙ্গে। সেই বৈঠকে টাটার প্রতিনিধিও ছিলেন। এখানেই মমতা টাটার প্রতি শিল্প গড়ার ডাক দিয়ে বলেন, ‘একটা জায়গার কথা ভুলে যান। অনেক জায়গা আছে। সেখানে আপনারা বিনিয়োগ করুন।’ এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরের বিজয় উৎসব মঞ্চ থেকে মমতা ফিরিয়ে দেন সিঙ্গুরের জমি কৃষকদের হাতে। যাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা নেননি, তাঁদের হাতে তুলে দেন অর্থের চেক। পাশাপাশি টাটাকে এই রাজ্যে শিল্প গড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এক মাস সময় দিলাম, আপনারা ভাবুন। এখানে শিল্প গড়ুন। আমাদের গোয়ালতোড়ে এক হাজার একর জমি আছে। জমি আছে পানাগড় ও হাওড়ায়। আপনারা পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে শুরু করুন শিল্প স্থাপনের কাজ।’ মমতা এ কথাও জানান, আর জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। প্রয়োজনে আমরা কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে নেব। যদিও মমতার এই ডাকে টাটা সাড়া দেয়নি এখনো।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সিঙ্গুরের মতো পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েকটি এলাকায় বাম আমলে অধিগ্রহণ করা জমি ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন শুরু করেছেন জমিদাতারা। তাঁরা দাবি করেছেন, সিঙ্গুরের মতো তাঁদের অধিগৃহীত জমিও ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ঘটনার পর রাজনৈতিক মহলে একটি প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি আর পশ্চিমবঙ্গে অধিগ্রহণ করা জমিতে শিল্প স্থাপন করা যাবে না?
বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে উল্লাস উপনগরী-সংলগ্ন আলিশা মৌজায় তৎকালীন রাজ্যসরকার একটি ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল মিষ্টি তৈরির কারখানাগুলোর জন্য মিষ্টিহাব বানানোর উদ্দেশ্যে। সিঙ্গুর মামলার রায় ঘোষণার পর এই জমি ফেরত দেওয়ার জন্য জমিদাতারা আন্দোলন শুরু করলে মুখ্যমন্ত্রী দাবি মেনে নিয়ে মিস্টিহাব অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। একইভাবে শিলিগুড়ির কাওয়াখালীতে উপনগরী গড়ার জন্য বামফ্রন্ট আমলে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এই জমিও ফেরত দেওয়ার দাবিতে শিলিগুড়িতেও শুরু হয়েছে আন্দোলন।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুরেও অধিগৃহীত প্রায় ৩ হাজার একর জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন জমিদাতারা। ২০০৭ সালে এখানে রিলায়েন্স গোষ্ঠী, ইমামি গোষ্ঠী, জয়বালাজি গোষ্ঠী, ডিভিসি ও ভারতীয় রেলকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এই জমি দেওয়া হয়েছিল।
শেষ কথা, মমতা সিঙ্গুর বিজয় করেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে তা হলো, এভাবে যদি অধিগৃহীত জমি ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন চলে, তবে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের ভাগ্য কী হবে? শিল্পপতিরা কোন বিশ্বাসে এই রাজ্যে পা দেবেন? যদিও মমতা তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, রাজ্য সরকারের ভূমিব্যাংকে রয়েছে প্রচুর জমি। সেখান থেকেই দেওয়া হবে শিল্প স্থাপনের জমি। কিন্তু সেই জমি শিল্পপতিদের পছন্দ হবে কি না, সেই প্রশ্নটিও এখন অবশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।