মন্ত্রী-সাংসদের বাগযুদ্ধ ও উড়ালসড়ক

মন্ত্রী একজন সাংসদকে বললেন, ‘আপনাকে এখানে ভাড়া করে আনা হয়েছে।’ আর সাংসদ বললেন, ‘আপনার আগ্রহে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে, আপনিই প্রকৌশলীকে দিয়ে এই পেপার (প্রবন্ধ) লিখিয়েছেন।’ এরপর সাংসদ মারমুখী হয়ে তেড়ে গেলেন মন্ত্রীর দিকে। বৈঠকে উপস্থিত অন্য বিশিষ্টজনেরা নিবৃত্ত করলেন তাঁকে। ততক্ষণে উপস্থিত দর্শকদের কেউ মন্ত্রীর পক্ষে কেউবা সাংসদের পক্ষে বিবাদ ও হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়েছেন। সভা ভন্ডুল হয়ে গেল।
দ্য ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্র আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ও সাংসদ আফছারুল আমীনের এই ‘যুদ্ধের’ সচিত্র সংবাদ অনেকেই পত্রপত্রিকায় দেখেছেন। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলা নিরসনে করণীয় ঠিক করার জন্য যে বৈঠক, সেই বৈঠকের এই চিত্র দেখে আঁচ করা যায় বিশৃঙ্খলা শুধু সড়কে নয়, তা আছে আমাদের নীতিনির্ধারকদের চিন্তার মধ্যেও।
রাজধানী ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও যানজট ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা এখন বড় সমস্যা। বন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের কেন্দ্র বলে এই নগরের সমস্যাটির দ্রুত সমাধান অবশ্যম্ভাবী—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু উড়ালসড়কই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ কি না, এমনকি উড়ালসড়ক আদৌ এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখবে কি না—তা নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন। চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন মহল বারবার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত হাজির করে এই শহরে উড়ালসড়কের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফোরাম ফর প্ল্যান্ড চিটাগাং (এফপিসি), আইইবির চট্টগ্রাম কেন্দ্র বিভিন্ন সময় তাদের আপত্তির কথা নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কর্তৃপক্ষের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে পরপর দুটি প্রকল্পের ব্যর্থতা দেখলাম আমরা—বহদ্দারহাট ও কদমতলী উড়ালসড়ক। এ দুটি উড়ালসড়ক আদৌ নগরবাসীর কোনো উপকারে লেগেছে কি না, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দিনের যেকোনো সময় যানবাহনশূন্য উড়ালসড়ক ও তার নিচে সাধারণ সড়কগুলোতে তীব্র যানজটের চিত্রই এই ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।
আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্র আয়োজিত যে সভাটি সেদিন (৯ এপ্রিল) হইহট্টগোলে পণ্ড হয়ে গেল, তাতে মূল প্রবন্ধ (যেটি মন্ত্রীর ‘আগ্রহে’ লেখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সাংসদ) উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া যানজটের মূল সমস্যা হিসেবে যে কয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন, তা হলো—একই সড়কে রিকশার মতো ধীরগতির অযান্ত্রিক যানের পাশাপাশি মোটরচালিত যানবাহন চলাচল করে, কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই, কোনো যানবাহন চাহিদাব্যবস্থাপনা নেই, পরিকল্পিত গণপরিবহনব্যবস্থা নেই, যথার্থ ফুটপাত নেই, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই, ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নেই এবং জনগণের ট্রাফিক আইন মেনে চলার ইচ্ছাও নেই।
এই সমস্যাগুলো নিয়ে কারও দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই সমস্যাগুলো নিয়ে কখনো কার্যকর আলোচনা হয়েছে কি না এবং নগর উন্নয়নে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে বড় বড় প্রকল্পের চেয়ে কম বিনিয়োগে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন এখন নিশ্চয় উঠবে। কাতালগঞ্জসহ চট্টগ্রাম কলেজ সড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়ে সিডিএ বহদ্দারহাট বা কদমতলী উড়ালসড়ক নির্মাণের চেয়েও বেশি সুফল পেয়েছে। একই অঞ্চলে চকবাজার সড়ককে যানজটমুক্ত করার উদ্যোগটিও কার্যকর পদক্ষেপ বলে মনে করেন নগরের মানুষ। তাহলে এই সফল কাজগুলোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত না রেখে পুরো শহরজুড়ে তথাকথিত ‘দৃশ্যমান’ উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

>সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য আন্তরিক ও অর্থ বরাদ্দ দিতে আগ্রহী। কিন্তু ‘দৃশ্যমান উন্নয়নে’র চমক সৃষ্টির পরিবর্তে মাস্টারপ্ল্যানে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হলেই এই অর্থ ব্যয় অর্থবহ হবে

সড়কের পাশে জমি অধিগ্রহণ, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, হকারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ফুটপাতকে পথচারীর জন্য অবাধ করা এবং রিকশার জন্য আলাদা লেন করা ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হলে অন্তত ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হতো বলে বিশ্বাস করেন বিশেষজ্ঞরা। খোদ ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গ্যারি হ্যাক সম্প্রতি বলেছেন, ‘সড়কের অপ্রতুলতা নয়, বরং যানব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাবই এই সমস্যার কারণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাস্তার পাশে ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করে রাখা ও বাসসহ গণপরিবহনগুলো রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর ফলে একটি তিন লেনের সড়ক মুহূর্তের মধ্যে এক লেনের সড়কে পরিণত হয়।’ আইইবির গোলটেবিল বৈঠকে প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া হয়তো এ কথাটির প্রতিধ্বনি করেই বলেছেন, বিরাট অর্থ ব্যয় না করে শুধু উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই একটি সড়কের ধারণক্ষমতা চার স্তরে উন্নীত করা সম্ভব।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে আমরা একমত হতে পারি না। তার চেয়েও বড় কথা, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মতামত জানতে চাওয়া বা সেই মত বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজনটুকু বোধ করেন না নীতিনির্ধারকেরা। আইইবির গোলটেবিলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেছেন, উড়ালসড়ক নির্মাণের আগে এ বিষয়টি নিয়ে এ অঞ্চলের কোনো সাংসদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। তাঁরা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। জনগণের কল্যাণে যে উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেই উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হওয়া উচিত। অথচ জনপ্রতিনিধিরাই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না—এ রকম কথা শোনার পর এসব উদ্যোগের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ-সংশয় জাগে, সাফল্য নিয়ে তো বটেই।
আইইবির সেমিনারের পর সিডিএ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছে, কদমতলী উড়ালসড়কে ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এই হিসাবে এই সড়কে যান চলাচলের সংখ্যা ঘণ্টায় মাত্র ৫৪৬টি। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘণ্টায় অন্তত আট থেকে দশ হাজার যান চলাচল না করলে উড়ালসড়কটিকে কার্যকর বলার কোনো যুক্তি নেই। সিডিএর বিজ্ঞাপনে বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক সম্পর্কে বলা হচ্ছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কালুরঘাটমুখী ওয়াই সেইফ র্যা ম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার এবং লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মিত হলে এর সুফল পাওয়া যাবে। আমরা যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে মুরাদপুর-লালখানবাজার উড়ালসড়কের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করতে এলে মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এর অসম্পূর্ণতার কথা তুলে ধরে বিমানবন্দর পর্যন্ত তা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন। তাতে সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ ওয়াই আকৃতির র্যা ম বা লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণ ‘পূর্বপরিকল্পনা’র অংশ—এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কাজ শুরু করার পর নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার সামনে নতুন করে এসব পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এমনকি মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন যে উড়ালসড়ক বিমানবন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিয়েছেন, তা-ও কতটা কার্যকর উদ্যোগ—এ নিয়ে প্রশ্ন আছে বিশেষজ্ঞদের।
আইইবির সেমিনারে আরেকজন বক্তা প্রকৌশলী আলী আশরাফ যে কথা বলে বক্তব্যের উপসংহার টেনেছেন, তা অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনায়। তিনি বলেছেন, ‘মুরাদপুর-লালখানবাজার উড়ালসড়ক এখন বাস্তবতা। এতে বিরাট সরকারি অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। এখন এতে আর পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এটা শুধুই একটি একাডেমিক আলোচনা, যার মধ্য দিয়ে আমরা জানাতে চাই, বিনিয়োগের তুলনায় উড়ালসড়ক থেকে আমরা আশানুরূপ সুফল পাব না।’
এই হতাশার পরও তিনি যে কথাটি বলেছেন, আমরাও তার প্রতিধ্বনি করে বলতে চাই, বোঝা যাচ্ছে সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য আন্তরিক ও অর্থ বরাদ্দ দিতে আগ্রহী। কিন্তু ‘দৃশ্যমান উন্নয়নে’র চমক সৃষ্টির পরিবর্তে মাস্টারপ্ল্যানে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হলেই এই অর্থ ব্যয় অর্থবহ হবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]