মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস এবং জোট অদল–বদলের ঘটনা থেকে আমরা কী ধারণা পেতে পারি? সেখানে বৈরী সম্পর্কের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক আদান-প্রদান গতি পাচ্ছে। আর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরছে। সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক ও মিসরের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে নতুন করে ছক কষছে। এমনকি বৈরী প্রতিবেশীর সঙ্গে তারা সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সেখানে তাদের আঞ্চলিক শক্তিমত্তা নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে। আর চীন সেখানে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঢুকে পড়েছে।
ভূরাজনৈতিক এই বদল মধ্যপ্রাচ্যকে আরও হিংস্র পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু এটি আবার একই সঙ্গে দেশগুলোর মধ্যকার বহু বছরের বৈরিতার অবসান ঘটানোর সুযোগ এনে দিয়েছে।
এই অঞ্চল থেকে আমেরিকা নিজেদের শক্তি খর্ব করার ফলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সামনে নিরাপত্তার প্রশ্নে পারস্পরিক বৈরিতার দেয়াল মেরামতের সুযোগ এসেছে। সেখানকার নেতারা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, জ্বলন্ত আগুনে ‘ঘি ঢেলে দিলে’ কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছেন, তাঁর প্রশাসন বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যকে আর অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। বাইডেন নিজেকে সৌদি আরব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে তিনি সমর্থন দিচ্ছেন না। তাঁর প্রশাসন ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত ২০১৫-এর ইরান পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধারের কূটনীতি বহাল রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাইডেন যে বার্তাটি দিতে চাইছেন সেটি হলো, তাঁর প্রশাসন আফগানিস্তান ঘিরে আঞ্চলিক ‘শীতল লড়াইয়ে’ যুক্ত হতে চাইছে না।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকা নিজেদের যত গুটিয়ে আনছে, চীন সেখানে ততটাই পরিচিত মুখ হয়ে দেখা দিচ্ছে। গত মার্চ মাসে তারা ইরানের সঙ্গে বড় একটা চুক্তি করে ফেলেছে। এ চুক্তিতে আগামী ২৫ বছর ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর বদলে তেল ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন নিশ্চয়তা চেয়েছে চীন।
ওয়াং তাঁর সফরে ‘চীনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির’ বিপুল সম্ভাবনার একটা দোলা সেখানে দিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মিষ্টি বাতাস মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এখন বইছে। মহামারি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেখানে তরুণদের কর্মসংস্থানের হার, দারিদ্র্যের সীমা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচক পড়তির দিকে ছিল। আর মহামারির গত ১৮ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সামাজিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংলাপ ও কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু যে হবে, সেটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। সেখানকার বেশির ভাগ শাসকই বুঝতে পেরেছেন, তাঁদের শাসন টিকে থাকা নির্ভর করছে জনগণের চাহিদা কীভাবে তাঁরা পূরণ করছেন, সেটার ওপর। তাঁরা বুঝতে পারছেন, গোষ্ঠীগত উত্তেজনা কিংবা অন্যদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর নীতি আর কাজে আসছে না। এই প্রেক্ষাপটে গত এপ্রিলে সৌদি আরব ও ইরান একটা গোপন বৈঠক করে ফেলেছে।
সৌদি আরব কাতারের সঙ্গে পুরোনো বিবাদ মিটমাটের উদ্যোগ নিয়েছে। পুনর্মিলনের শক্তিশালী নিদর্শন হিসেবে গত এপ্রিলে সৌদি বাদশাহ সালমান কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামিদ আল-থানিকে সৌদি সফরে আমন্ত্রণ জানান। নিজেদের সীমান্তে রাজনৈতিক সমীকরণের পুনর্বিন্যাস ঘটাচ্ছে সৌদি আরব। তারা ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। সৌদি আরবের কর্মকর্তারা দামেস্কে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রশাসনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন।
ইরানও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ গত এপ্রিলে কাতার, ইরাক, কুয়েত ও ওমানে ফুরফুরে এক সফর শেষ করেছেন।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের পুনর্মিলনের সম্ভাবনা। যদিও ইরানে মধ্যপন্থী হাসান রুহানির বদলে কট্টরপন্থী ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা তিনি দেখছেন না। মধ্যপ্রাচ্যে এ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে সিরিয়া ও ইয়েমেনের গৃহবিবাদ ও ছায়াযুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদে জেরবার ইরাক ও লেবাননে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সম্পর্ক মেরামতের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক এই পুনর্বিন্যাসকে দুটি বিষয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন এবং সমস্বার্থ। এই অঞ্চল থেকে আমেরিকা নিজেদের শক্তি খর্ব করার ফলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সামনে নিরাপত্তার প্রশ্নে পারস্পরিক বৈরিতার দেয়াল মেরামতের সুযোগ এসেছে। সেখানকার নেতারা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, জ্বলন্ত আগুনে ‘ঘি ঢেলে দিলে’ কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।
পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত মধ্যপ্রাচ্য গড়তে এবং সেখানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরাপত্তা সৌধ নির্মাণে নতুন একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক মহল কি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারবে? নিদেনপক্ষে পারস্পরিক সংলাপ এবং আঞ্চলিক সংঘাত ব্যবস্থাপনার যে ক্ষেত্র সেখানে তৈরি হয়েছে, সেটাকে সমর্থন ও উৎসাহ কি তারা দিতে পারবে? এটা আর খুব বেশি দিনের জন্য কাল্পনিক ভাবনা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অতীতকে সীমাহীন সংঘাত দিয়ে চিহ্নিত করা হতো, কিন্তু এটা এই অঞ্চলের অনড় নিয়তি নয়।
● ফাওয়াজ এ জর্জ লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ে অধ্যাপক