বাংলাদেশের সমাজজীবন এখনো নানা অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, সাহস ও সংঘাতে ভরপুর। একদিকে রয়েছেন শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে রয়েছে মৌলবাদী এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, লুটেরা গোষ্ঠী, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী, নানা ধরনের লুম্পেন মাস্তান চক্র, দলের মধ্যে উপদল ইত্যাদি শান্তিভঙ্গকারী শক্তি ও তাদের সহিংস সমর্থকবৃন্দ। সর্বত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে লুটেরা দুর্বৃত্তদের দাপট এবং তা দমনে সরকারের চরম ব্যর্থতা ও সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব। এসব সংকট ও সংঘাতের সমাধান না হলে এই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে প্রতিক্রিয়াশীলরা বাংলাদেশকে পুনরায় ৪৫ বছর পিছিয়ে পাকিস্তানি বাংলাদেশে পরিণত করবে।
বর্তমান রাজনীতিতে প্রধান যে সংকটটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে গণতন্ত্রের সংকট। বর্তমানে এমন একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, যেখানে সব মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল অংশ নিতে সক্ষম হবে এবং জনগণও খুশিমতো নিজের নিজের ভোট পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে দিতে পারবেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত বহু বছরের আওয়ামী শাসনামলের নানা ব্যর্থতার কারণে জনগণের একটি বৃহৎ অংশ বিএনপির বা ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যদিও বিএনপি কর্তৃক আওয়ামী ব্যর্থতাগুলো দূর হবে এই প্রত্যাশা জনগণ করে না।
বিপদ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, সুকৌশলী ও সুসংগঠিত জামায়াতে ইসলামী এই সুযোগে বিএনপির ওপর ভর করে, শাসক দলের ভেতরে ঢুকে, রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র তৈরি করে এবং মৌলবাদী মালিকানায় পরিচালিত অর্থনীতির ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কৌশলে ক্ষমতায় অতীতের মতো ভবিষ্যতেও ফিরে আসতে চাইছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপি তাকে পরিপূরক শক্তি হিসেবে আজও সঙ্গে রেখেছে।
সুতরাং এই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এমন একটি উত্তরণকালীন সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, যাতে একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জঙ্গি-সন্ত্রাসী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাময়িক নেতিবাচক উত্থান রহিত ও পরাজিত হয়। সেটা সম্ভব হলে আমরা মহাবিপদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারব। এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কমরেড মণি সিংহের কাছ থেকে সাধারণভাবে জাতি এবং বিশেষভাবে তাঁর অনুসারী বামেরা কী শিক্ষা পেতে পারে, তা নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে কিছু আলোচনা করব।
মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গে মণি সিংহ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কমরেড মণি সিংহ জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন সম্পর্কে কী বলেছিলেন? স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে কমরেড মণি সিংহ প্রদত্ত সাক্ষাৎকার থেকে এ বিষয়ে আমরা জানতে পারব। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ বলেছেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করে আমরা (কেন্দ্রীয় কমিটি) আরও দেখেছিলাম যে আওয়ামী লীগ কেবল “পূর্ব-পাকিস্তানের” জনগণেরই সর্বাত্মক সমর্থন পায়নি, তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার গঠনের অধিকার লাভ করেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো এবং এই শাসকদের মদদদাতা সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে নেবে না এবং তা বানচাল করার ষড়যন্ত্র করবে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীনতার সংগ্রামের দিকেই অগ্রসর হবে এবং সে সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।’
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেদিকে এগিয়ে গেলে পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলো পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। এই মুষ্টিমেয় অংশকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রশ্ন ১৯৭১ সালে সামনে চলে আসে। তখন বামপন্থীদের মধ্যে দুটো মত বিরাজ করছিল। একটি মত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করা। অপর মতটি মুক্তিযুদ্ধকে দেখছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে। তবে কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী বামের আরেকটি অংশ স্বকীয় পৃথক অবস্থান বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়াই চালানোর কথাও বলেছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ‘জাতীয় ইস্যুতে’ জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে এগোনোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ। ‘জাতীয় ইস্যু’র বিপরীতে বামপন্থী অবস্থানকে তিনি ‘বিভেদাত্মক’ এবং ‘ভ্রান্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
জাতীয়তাবাদী ও বাম শক্তির সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মণি সিংহ
আমরা জানি, সাধারণত ‘জাতীয় ঐক্যের’ মধ্যে বাম ও ডানপন্থী উভয় প্রকার শক্তি বিদ্যমান থাকে। সেই জাতীয় ঐক্য জনগণের স্থায়ী কল্যাণে কতটুকু আসবে, তা নির্ভর করে ঐক্যের ভেতরে শক্তির ভারসাম্য ও নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্রের ওপর। এ বিষয়টি সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ কি সজাগ ছিলেন? তাঁর সাক্ষাৎকারের আরেক অংশে আছে—
‘আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তির বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়নি। শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠিত হয় এবং তাতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিরূপে আমি ছিলাম। সশস্র সংগ্রামের অগ্রগতির পর্যায়ে আমাদের উভয় দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, জাতীয় কংগ্রেস ও মাওলানা ভাসানীকে (ব্যক্তি হিসেবে) নিয়ে গঠিত হয়েছিল ঢিলেঢালা ‘পরামর্শদাতা কমিটি’। এ ছাড়া মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ইত্যাদি আওয়ামী নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীর কাজের সমন্বয়ের জন্যও একটি ‘কো-অর্ডিনেশন’ কমিটি গঠিত হয়েছিল। এসব প্রচেষ্টা অবশ্য খুব বেশি সফল হয়নি।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষায় উপনীত হতে পারি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বা ধর্মীয় মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে বামপন্থীদের সঙ্গে অন্যান্য শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় ঐক্যের সুনির্দিষ্ট রূপ এমন হতে হবে, যাতে জাতীয় ইস্যুর সমর্থক বামপন্থীদের অন্যান্য উচ্চতর শ্রেণিসংগ্রামগুলো চালানোর স্বাধীন সুযোগ ও অধিকার বজায় থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের শক্তি ভারসাম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার মানে ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য ও সংগ্রাম এবং সংগ্রামের মধ্যে ঐক্যের একটি যুগপৎ মিল ঘটিয়ে জাতীয় ইস্যু এবং শ্রেণিসংগ্রামের ইস্যুকে একই সঙ্গে অগ্রসর করে নিতে হবে। এই জটিল কৌশলেরই অনুমোদন আমরা মণি সিংহের উল্লিখিত সাক্ষাৎকারে পাচ্ছি।
তবে উপরিউক্ত রাজনৈতিক দিকটি ছাড়াও অন্য আরও অনেক প্রসঙ্গে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় কমরেড তাঁর সমগ্র জীবনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, বিপ্লবী মানবতাবাদ, শ্রমজীবী মেহনতিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, সংগঠনের অধস্তন ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দরদ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই আমাদের নানা জনের নানা স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে।
এই মহান নেতার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।