ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ কেন

গত ২৯ মে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে সিলেট এলাকায় সংঘটিত ৪ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৮ মাত্রার ৫টি ভূমিকম্প যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে, সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে ছোট ভূমিকম্পও ঝুঁকির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয়, ইউরেশীয়, বার্মিজ—এই তিন সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় দেশের উত্তর ও পূর্ব দিকে প্রতিনিয়ত ভূকম্পন হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা ও জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। তাহলে এ ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া বা ঝুঁকি হ্রাসের উপায় কী?

ভূমিকম্প সম্বন্ধে একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো, ভূমিকম্প নিজে কাউকে মারে না, কিন্তু কম্পনের ফলে অবকাঠামো জান-মালের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভূমিকম্প সংঘটনে ভূগাঠনিক-ভূতাত্ত্বিক-ভূপদার্থিক প্রক্রিয়ার দুর্বোধ্যতার কারণে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা প্রদানে কার্যকর কোনো পন্থা এখনো বের হয়নি। তবে অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলবাসীদের জন্য সেলফোনে সতর্কবার্তা প্রদানের সক্ষমতার খবর জানা গেছে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে সময় পাওয়া যাবে মাত্র ৮০ সেকেন্ড। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর হতে পারে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধের, ট্রেনের গতি কমানোর ও লিফট বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ভূকম্পনজনিত ঝুঁকি হ্রাসে টেকসই ব্যবস্থা হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রস্তুতি।

নিকট অতীতের ভূমিকম্পগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আতঙ্কে ভবনগুলো থেকে হুড়োহুড়ি করে বেরোতে গিয়ে অনেকে হতাহত হয়েছেন, হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্বন্ধে সচেতনতা এমন হতাহতের পরিমাণ কমাতে পারে। কারণ, ভূমিকম্পের পর্যায়ভিত্তিক, অর্থাৎ ভূমিকম্প-পূর্বকালীন ও পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যাপক স্বীকৃত করণীয় রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্প-পূর্ব স্বাভাবিক সময়ে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণকালে নির্মাণ বিধিমালার কঠোর অনুসরণ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে প্রধানতম করণীয়।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, দেশের উত্তরের ডাউকি চ্যুতি ও পুবের প্লেটবাউন্ডারি-সংশ্লিষ্ট এলাকা ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের উৎস হতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয় এগুলোর উৎস, বৈশিষ্ট্য ও ক্ষতির করার আশঙ্কা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা মূলত হলোসিন উপযুগের নরম ও অসংহত পলি দিয়ে গঠিত, ৮ শতাংশ প্লাইস্টোসিন উপযুগের কাদাসমৃদ্ধ মৃত্তিকা ও অবশিষ্ট ১২ শতাংশ টারসিয়ারি যুগের পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। ভিন্ন ভৌত গুণাগুণসম্পন্ন হওয়ায় ভূকম্পন এসব পলিমাটি-শিলাতে ভিন্ন ধাঁচে প্রভাব ফেলবে, আবার ভিন্ন মাত্রার কম্পনে দৃশ্যপট পাল্টাবে।

ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনা এবং পলিমাটি-শিলায় এসবের সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে আরও সমীক্ষা প্রয়োজন, যার ফলাফল ভবন নির্মাণ নীতিমালা বা বিল্ডিং কোড পরিমার্জনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথা ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমে সহায়ক।
ভূতাত্ত্বিক গবেষণা বলে, কোনো স্থানে ভূমিকম্প সুদূর অতীতকাল থেকে ফিরে ফিরে এসেছে। কারণ, ওই এলাকায় ক্রমাগত শক্তি সঞ্চিত হয়ে পরবর্তীকালে বিমুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি ও টেকসই প্রস্তুতির জন্য দেশে ব্রডব্যান্ড সেইসমিক স্টেশনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির সহায়তায় উপাত্ত সংগ্রহ ও পরিবীক্ষণসুবিধা বৃদ্ধিতে এবং বহুবিষয়ক গবেষণায় জোর দেওয়া প্রয়োজন।

ড. এ কে এম খোরশেদ আলম গবেষক ও ভূতত্ত্ববিদ
[email protected]