রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে চলমান ভূ-অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব একটি জটিল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এটি ইউক্রেন যুদ্ধের মতোই অনেক বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্যে ভরা। উভয় পক্ষই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আধিপত্যের দাবি করছে। কিন্তু আমাদের সামনে আসা তথ্য-প্রমাণ বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, ক্রেমলিন পিছু হটতে শুরু করেছে।
গত ২৯ এপ্রিল রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, তারা দুটি ওভারডিউ ইউরোবন্ডের জন্য বিদেশি ঋণদাতাদের প্রায় ৬৫ কোটি ডলার ফেরত দেবে। এই সভরেন বন্ডের অর্থ পরিশোধের শেষ তারিখ ছিল ৪ মে। রাশিয়া তার আগেই সে অর্থ পরিশোধ করেছে এবং ক্রেমলিন খেলাপির মধ্যে পড়া থেকে বেঁচে গেছে। সাদাচোখে এটিকে রাশিয়ার জন্য একটি জয় বা সাফল্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আদতে পদক্ষেপটি ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য বেশ বিব্রতকর ছিল।
রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত অবশ্য চিরকাল বাড়তে থাকবে না। কারণ, তাকে যুদ্ধের খরচ বহন করতে হচ্ছে এবং তেল ও গ্যাসের বাজারগুলো আবার সমন্বয় করা হচ্ছে। বরং এখন রাশিয়া তার জ্বালানির মূল গ্রাহক হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। উপরন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু তাদের অঞ্চলে রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে না, বরং রাশিয়া যাতে বিশ্বের কোথাও তেল বিক্রি করতে না পারে, সে জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
বন্ডটির আনুষ্ঠানিক ম্যাচিউরিটির তারিখ ৪ এপ্রিল আসার আগে ক্রেমলিন ঘোষণা করেছিল তারা এই বন্ড বাইব্যাক করবে, অর্থাৎ বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ক্রেমলিন আবার ঋণ নেবে। তবে গতবার ইউরোতে বন্ড বিক্রি করলেও এবার তারা রুবলে বন্ড ছাড়বে বলে ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে ঘোষণা দেয়, যেসব দেশ রুবলে তা কিনতে রাজি হবে না, সেসব বন্ড রাশিয়া নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবে। প্রায় ৭৬ শতাংশ বন্ডহোল্ডার (তাদের প্রায় সবাই দেশীয়) নতুন শর্তে সম্মত হয়েছেন।
উৎসাহিত হয়ে ক্রেমলিন ৬ এপ্রিল ঘোষণা করেছিল, তারা অন্যান্য বন্ডহোল্ডারদের জন্য সেটআপ করা অ্যাকাউন্টগুলোতেও রুবল জমা করছে। ক্রেডিট ডেরিভেটিভস ডিটারমিনেশন কমিটিগুলো এটিকে একটি ‘সম্ভাব্য-ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ’ প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করেছিল এবং রায় দিয়েছিল, রাশিয়া যদি সর্বশেষ সময়সীমা ৪ মের মধ্যে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশটি কার্যকরভাবে খেলাপি হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার কর্মকর্তারা পশ্চিমের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত করেছিলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রাশিয়ার প্রবেশাধিকার সীমিত করে রাশিয়াকে খেলাপি বানানোর চক্রান্ত করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার ওপর নজরদারি করা মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ অবশ্য স্পষ্ট করেছে, রাশিয়াকে তার বিদ্যমান তেল ও গ্যাস বিক্রয় থেকে উপার্জন করা তহবিল দিয়ে ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে এসব নিষেধাজ্ঞায় কোনো বাধা রাখা হয়নি।
বিদেশি মুদ্রায় বন্ড প্রদানের রাশিয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত দেশটিকে অন্যান্য ঋণ এবং মামলার জটিলতা এড়াতে সক্ষম করেছে। যাহোক, এ পদক্ষেপ ক্রেমলিনকে চরম ভণ্ডামিপূর্ণ এবং বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। দিন শেষে পুতিন যা করেছেন তা হলো রুবল দিয়ে অভ্যন্তরীণ বন্ডহোল্ডারদের পাওনা পরিশোধ করছেন। এ রুবল তাঁরা বিদেশে ব্যয় করার জন্য অবাধে কাগজের মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারছেন না। অন্যদিকে বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের সম্পূর্ণ অর্থ ডলারে দেওয়া হচ্ছে। এটা মোটেও ভালো কথা হতে পারে না।
পুতিন সম্ভবত ইউক্রেন আক্রমণের শুরু থেকে তেল ও গ্যাস বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়ার বিদেশি মুদ্রা মজুত রেকর্ড মাত্রায় নিয়েছিলেন। মনে হচ্ছে শিগগিরই সেই গুরুত্বপূর্ণ আয়ও হারাতে যাচ্ছে রাশিয়া। ৪ মে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ান তেল ক্রয় পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরই) হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার দিন থেকে আমার এ লেখা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রাশিয়া ইইউতে তেল বিক্রি করে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার আয় করেছে।
এ রেকর্ড আয়ের একটা বড় অংশ এসেছে উচ্চমাত্রার হাইড্রোকার্বন নিঃসরণের বিনিময়ে। তবে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত অবশ্য চিরকাল বাড়তে থাকবে না। কারণ, তাকে যুদ্ধের খরচ বহন করতে হচ্ছে এবং তেল ও গ্যাসের বাজারগুলো আবার সমন্বয় করা হচ্ছে। বরং এখন রাশিয়া তার জ্বালানির মূল গ্রাহক হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। উপরন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু তাদের অঞ্চলে রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে না, বরং রাশিয়া যাতে বিশ্বের কোথাও তেল বিক্রি করতে না পারে, সে জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইইউ তাদের নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থার প্যাকেজটিতে রাশিয়ান তেলের পরিবহনে নিষেধাজ্ঞাও অন্তর্ভুক্ত করেছে। অর্থাৎ রাশিয়া যাতে ইউরোপের মিত্র কোনো দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তেল রপ্তানি করতে না পারে, সে জন্য তারা সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইইউ ব্লকের বাইরে প্রতিষ্ঠিত শিপিং কোম্পানিগুলো এ নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারে। তবে প্যাকেজটি এ ধরনের শিপিংয়ের জন্য বিমা পরিষেবার বিধানকেও বাধাগ্রস্ত করবে। শিপিং ইনস্যুরেন্স মার্কেটে ইইউ, কানাডীয় এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য থাকায় এটি এড়ানো রাশিয়ার জন্য অনেক বেশি কঠিন হবে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কাছে শিপিং খাত কতটা বাধা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে যে কেউ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানি সোভকমফ্লট-এর দিকে নজর দিতে পারেন। ৩ মে বিশেষজ্ঞ সামুদ্রিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত প্রকাশনা লয়েড একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সোভকমফ্লট তার ১২১টি জাহাজের মধ্যে ৪০টি বিক্রি করতে চেয়েছে। ১৫ মে এ জাহাজগুলোর ওপর ইইউর পূর্ণমাত্রার অবরোধ কার্যকর হবে। তখন আন্তর্জাতিক জলসীমায় এগুলো চলতে পারবে না। সে কারণে আগেভাগে সেগুলো রাশিয়া বেচে দিতে চাইছে।
এসব পদক্ষেপের কারণে রাশিয়ার রাজস্ব আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে এই ভূ-অর্থনৈতিক যুদ্ধে পশ্চিমারা জয়লাভ করছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো