ভিআইপিরা আইন মেনে লাইনে আসবেন কবে?

ভিআইপি তিনটি শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। তবে এর সবগুলো বর্ণের অর্থ উন্মোচিত হলে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মতো উপমহাদেশ ভুক্ত অঞ্চলে তা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে বরাবরই। ‘সাধারণ’ নাগরিকেরা তখন চলে যান তফাতে, ভিআইপিরা হয়ে ওঠেন ‘অসাধারণ’। তারা পেতে থাকেন বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও। তা না হলে যে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ হওয়ার মজা টের পাওয়া যায় না।

এভাবে ভিআইপিরা যেমন অতিরিক্ত গুরুত্ব পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেন, তেমনি সাধারণ মানুষেরা বিনা মূল্যে পেয়ে যান দুর্ভোগ। এর জন্য কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয় না। এই পৃথিবীটাই এমন, যেখানে একজন বেশি সুবিধা পেলে, আরেকজনকে কম পেতেই হয়। কারণ রসদ থাকে সীমিত ও সীমাবদ্ধ। কেউ বেশি পেলে, কেউ কম পাবেই। আর আর কম পাওয়ার বিষয়টি সর্বদাই ক্ষমতাহীনদের কপালে জোটে। যদিও তারাই ভোট দিয়ে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার আস্বাদ দেন। উপমহাদেশের সংস্কৃতি হিসাবে নিলে বলতে হয়, যারা ভোট পান না, বরং দেন—তারাই হয়ে থাকেন ক্ষমতাহীন। যদিও রাজার আসনের নরম গদিকে তুলতুলে করা তুলার সরবরাহ এই ক্ষমতাহীনদের কাছ থেকেই আসে।

আমাদের দেশেও পরিস্থিতি একই। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এ দেশে টাকা ও ভোট ক্ষমতায় ওঠার প্রচলিত সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে। আর ক্ষমতা দণ্ড হাতে এলেই সোনার কাঠি, রুপার কাঠির ছোঁয়ার মতো দীর্ঘকালের তন্দ্রা ভেঙে যায় অলৌকিক মায়াজালে। সবাই হয়ে ওঠে ত্রস্ত। আহা, ভিআইপিদের সম্মান দিতে হবে যে!

ভিআইপিদের তোষণ এ দেশে নতুন নয়। নানা সময় শুনতে হয়েছে ‘সাধারণ’ নাগরিকদের অপেক্ষায় রেখে ‘অসাধারণ’ ভিআইপিদের পার পেয়ে যাওয়ার গল্প। এবার তাতে নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে। প্রথম আলোতে গত ২০ মার্চ প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, শিমুলিয়া ঘাটে জনপ্রতিনিধি, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, সরকারি দলের নেতা-পাতিনেতারাও এখন ভিআইপি সুবিধা ভোগ করে আসছেন।

ফেরিতে ওঠার জন্য সাধারণ মানুষের গাড়িগুলো সার বেঁধে অপেক্ষা করলেও ভিআইপিদের গাড়িগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে ফেরিতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। আর ভিআইপিদের এমন সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আঙুল উঠছে পুলিশ, আনসার ও ঘাটের কর্মীদের দিকে।

যদিও এমন ঘটনা আমাদের জন্য নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। এ দেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আমাদের জীবনে ছাপ রেখে যান। কখনো রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া থমকে যায়, কখনো হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গুরুত্বপূর্ণদের যাত্রার স্বার্থে। কখনো আবার ভিআইপিদের জন্য কোনো কোনো ‘অনলি পি (অনলি পারসন) ’-দের শুধু সময় নষ্ট করাতে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন হয় না। তখন জীবন দিয়ে মূল্য ঘোচাতে হয়, ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই রাতে যেমনটা করেছিল তিতাস ঘোষ।

সেদিন সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে কিশোর তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয়। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সময় ফেরিঘাটের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) পক্ষ থেকে ঘাটে কোনো ভিআইপি প্রথা না রাখার ঘোষণা এসেছিল। তবে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন কখনো হয়নি।

পুরো দেশেই ভিআইপি সংস্কৃতির অবসান কখনোই হয়নি। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে হবেও না। নির্দ্বিধায় এমন নেতিবাচক মনোভাব অবলম্বনের মূল কারণ হলো অনেকগুলো বছরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। এত দিনে এই ভিআইপি প্রথার কোনো পরিবর্তন যখন দৃষ্টিগোচর হলো না, তখন বুঝতে হবে এ নিরাময়যোগ্য নয়। আর সেটি বুঝতে পেরেই হয়তো ‘গণপ্রজাতান্ত্রিক’ এ দেশের মানুষেরা নিজেদের আক্ষরিক অর্থেই ‘প্রজা’ রূপেই ভাবা শুরু করেছেন। নিজেদের প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হতে পারলে যে নাগরিক হিসেবে সামর্থ্য সম্পর্কেও জানা-বোঝাটা হয়ে যায়। তখন আর হেল-দোল থাকে না কোনো। প্রতিবাদের বদলে সহনশীলতাই হয় বেঁচে থাকার হাতিয়ার।

যদিও ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা সর্বদা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, ভোট দেওয়া প্রজারাই আসল ‘রাজা’। কিন্তু তাতে কারও বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না। এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসনে থাকা এ দেশের মানুষদের মধ্যে হয়তো মজ্জাগতভাবেই মিশে গেছে নিজেরটা বিসর্জন দিয়ে ভিআইপিদের পাতে বাড়তি কিছু তুলে দেওয়ার সংস্কৃতি। ক্ষমতার পূজারি তো সবাই-ই, আমরা হয়তো তাতে এগিয়ে। সেই এগিয়ে থাকাটা যোজন যোজন কিনা, তা অবশ্য গবেষণার বিষয়। তাতেই স্পষ্টভাবে জানা যাবে, আমরা আসলে মানসিকভাবে কতটুকু ‘প্রজা’।

মানসিকতায় প্রজা বনে যাওয়াটাই অন্যদিকে নাগরিকদের মধ্যে গড়ে তোলে ক্ষমতা লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। যখন সবাই বুঝতে পারে যে, ক্ষমতাই এই সমাজে একজনের মান-ইজ্জত রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার, তখনই সৃষ্টি হয় ‘অমুক আপা বা তমুক ভাইয়ের’ লোক। কারণ ক্ষমতার জাদুই যে আপনাকে হাজারো অপেক্ষমাণ যাত্রীর আগে এক নিমেষে ফেরিতে তুলে নদী পার করে দিতে পারে! সেই পারাপারের নিশ্চয়তাই একজনের মধ্যে ক্ষমতার বলয়ে জায়গা করে নিতে উৎসাহ জোগায়।

সমস্যা হলো ‘অনলি পি’ নামের আক্ষরিক অর্থেই আমজনতাদের। এ সমাজে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের তাই ‘ভিআইপি’দের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতেই দিন যায়। হয়তো বাসায় ফিরে স্বগতোক্তির রূপে ওই ভিআইপিদের পিন্ডিও চটকান কেউ কেউ। তবে তা-ও হয় নিচু স্বরে। কারণ, কে না জানে, ভিআইপি মানে ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন। রাজ–রাজাদের কথা শোনানোর সাহস কি আর প্রজাদের মনে আসে?
তাই ভিআইপিদের আইন মেনে লাইনে আসার দাবি কেউ জানায় না। বরং ‘অনলি পি’ উপাধি পাওয়া মানুষেরা চলে আসে লাইনে, দাঁড়ায় সারিবদ্ধ হয়ে। এর অন্যথা করে ক্ষমতার তরবারির সামনে নিজের গলা কে এগিয়ে দিতে চায়, বলুন?

অর্ণব সান্যাল লেখক ও সাংবাদিক
arnab. sanyal@prothomalo. com