ভাষা নিয়ে কিছু সেকেলে ভাবনা

.
.

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হলে ভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাও যেন ১১ মাসের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। একটি মাস ভাষা থাকে আমাদের মনোভূমিতে, পতাকা উড়িয়ে। ফেব্রুয়ারি শেষ হলে সেই পতাকা আবার আমরা নামিয়েও ফেলি, আমাদের মনোযোগ দখল করে নেয় অন্য সব জাগতিক বিষয়। ভাষা নিয়ে এই এক মাসের সক্রিয়তাকে অনেকে বর্ণনা করেন আনুষ্ঠানিক অথবা আচারধর্মী হিসেবে। কিন্তু আমি মনে করি, এরও আবশ্যকতা আছে। আচারের পেছনে একটা প্রস্তুতি থাকে, কাল গণনা থাকে, তাগিদও থাকে (তাগিদটা প্রচল থেকে ছিটকে না পড়ার।) আচার যাঁরা পালন করেন, তাঁদের অন্তত একটি অংশ আচারের পেছনের উদ্দেশ্য এবং নিষ্ঠাকে জানতে চায়, বুঝতে চায়।
ফেব্রুয়ারিতে ভাষা নিয়ে যত কথা হয়, তার পেছনেও নিষ্ঠা থাকে, আবেগ থাকে, উদ্দেশ্য থাকে। একটা উদ্দেশ্য বাংলা ভাষাকে আরও কত স্বাস্থ্যবান, বেগবান করা যায়, উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম করা যায়, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-বিজ্ঞানচিন্তার আরও গতিশীল বাহন করা যায়, তার পথ খোঁজা। কারও উদ্দেশ্য থাকে বাংলা ভাষার ইতিহাসটা জানার, এর শ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার। কারও উদ্দেশ্য থাকে এর শুদ্ধতাকে দৃশ্যমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সস্তা বিনোদনের কেন্দ্রীয় ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তৈরি নানা বিকৃতি থেকে বাঁচানো। আবার কারও উদ্দেশ্য থাকে এটি প্রমাণ করা যে এই বিকৃতি আসলে বিকৃতি নয়, এটি ভাষার বহমানতার একটি পরিচয় এবং একে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করে নেওয়া উচিত। আমি মনে করি, এই শেষ উদ্দেশ্যটিকেও (যার সঙ্গে প্রথম তিনটি উদ্দেশ্যেরই আপাত একটা বিরোধ আছে) খোলা মন নিয়ে দেখতে হবে, যেহেতু এতে যে বিতর্ক তৈরি হবে, তা শেষ পর্যন্ত ভাষার শক্তিটাই তুলে ধরবে। মৃত ভাষা, মৃতপ্রায় ভাষা নিয়ে কোনো বিতর্ক হয় না। বিতর্ক পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা এবং যুক্তি-অযুক্তিগুলোই প্রমাণ করে। অনেকে এ রকম ভাবেন যে উত্তরাধুনিক যুগে শুদ্ধ-পবিত্র-সুন্দর এসব বিষয়কে আর এককবিশিষ্ট ও ধ্রুব বলে ধরা যায় না। আমিও কিছুটা তা-ই মনে করি। শুদ্ধ অথবা সুন্দর বলতে যা বোঝায়, তা কোন অথবা কার সংজ্ঞা থেকে? সেই সংজ্ঞা কি তৈরি করছে ক্ষমতা? ক্ষমতার কোনো প্রতিষ্ঠান? প্রাচ্যবাদ দেখিয়েছে, পশ্চিমের তৈরি ‘মান’ পুবকে মানহীন প্রমাণ করে তার ওপর সাংস্কৃতিক উপনিবেশ চাপিয়ে দিয়েছে। কেন? না, পুব অসভ্য, তাকে সভ্য করতে হবে। পশ্চিমের মান ছুঁতে পারলে পুব সভ্য হবে।
তারপরও উত্তরাধুনিকতার সূত্র ধরেই বৈশ্বিক, সর্বজনীন কোনো মানের বিপরীতে স্থানীয়, লোকজ মানের কাছে গেলেও কিছু বিষয়ে (কিছু বিশ্বাসে) একটা মতৈক্য দেখা যায়। লোকজ বিশ্বাস মাটি থেকে উঠে আসে, ওপর থেকে কেউ তা চাপিয়ে দিতে পারে না। ফলে সেই বিশ্বাসে সুন্দর ও সত্যের যে বিষয়গুলো থাকে, সেগুলোর প্রতিফলন থাকে মানুষের প্রতিদিনের কৃত্যে, চর্চায় ও চিন্তায়। এ জন্য কেউ যদি ভাষার শুদ্ধতা খুঁজতে যায় এ রকম একটি বিশ্বাস থেকে যে সেই শুদ্ধতার দেখা মিলবে মায়ের ভাষার ভেতরের সৌন্দর্যে, তাহলে তাকে সেকেলে বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমি নিজেকে সেই সেকেলেদের দলে আবিষ্কার করি। কারণ, আমি জানি এবং আমার অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত আছে ভাষার এই সৌন্দর্যের বিষয়টি। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি ভাষার ভেতরে একটা গান আছে, যে গানটি বাজাতে পারেন এর উৎকৃষ্ট চর্চাকারীরা। অনেক বছর আগে একবার পদ্মায় নৌকায় যেতে যেতে আমার হাত থেকে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র নিয়ে এক বন্ধু এর কিছু অংশ পড়ে শুনিয়েছিল। না, সেই গান পদ্মা অথবা প্রকৃতি তৈরি করেনি, আমার বন্ধুও কোনো কাজী সব্যসাচী ছিল না, সেই গান ছিল ভাষার। রবীন্দ্রনাথ তা বাজিয়েছেন। এই গান বাজিয়েছেন নজরুল-জীবনানন্দ-শামসুর রাহমান-সৈয়দ হক। ভাষার সবচেয়ে ভালো প্রকাশ সাহিত্যে, তবে এই প্রকাশ আমি দেখেছি জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান লেখাতেও, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চিঠিপত্রেও। আমাদের সময়ে আমরা যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি, তাতে আর সেই গান বাজে না। এটি বাজার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা এখন শুধু বিশেষ্য নয়, বিশেষণ নয়, ক্রিয়াপদও বিসর্জন দিচ্ছে ইংরেজি-হিন্দির কাছে। এখন বাংলা ভাষা এক ভয়ানক শঙ্কার ভাষা। অনেকে বলেন, এটিই স্বাভাবিক। হতে পারে। কিন্তু আমার ভয় এই ‘স্বাভাবিক’ ভাষা তার একটি মৌল স্বভাব ইতিমধ্যেই হারিয়েছে, এবং তা ভেতরের গানটাকে বাজতে না দিয়ে, সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলে। এখন এই স্বাভাবিক, এফএম ভাষা, দুর্দান্ত বাংলিশ ভাষা কী সাহিত্য রচনা করে, তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করি।
অথচ আমি যখন কোনো ইংরেজকে, কোনো ইতালীয়কে, কোনো আরব বা ইরানিকে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে শুনি, তখন তার ভেতরে যে একটা গান আছে, তা বুঝতে পারি। একবার ইরানে গিয়ে আমি এক চা-খানায় দুই ঘণ্টা বসে অনেকের কথা শুনে টের পেলাম, এরা নিখাদ মাতৃভাষা চর্চা করছে। পরদিন এক অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন ইংরেজি ও অন্য ভাষার শব্দ আছে, তবে প্রায় সবই বিশেষ্য, কিন্তু ইরানিরা তাদের আত্তীকৃত করে নিয়েছে। আমরাও হাজার হাজার বিদেশি শব্দ নিয়েছি, কিন্তু বাংলার জলহাওয়ায় তাদের ধুয়ে শুকিয়ে নিজের করে নিয়েছি। কিন্তু এখন যে ক্রিয়াপদ ধার করছি ইংরেজি থেকে, হিন্দি থেকে, সেগুলোকে কি পারব আমাদের জলহাওয়ায় ওই রকম প্রক্রিয়াজাত করতে? কে জানে। তবে ক্রিয়াপদ হচ্ছে ভাষার পা। পা হারালে ভাষা কীভাবে চলে?
২. আমার সেকেলে চিন্তার আরেকটি হচ্ছে, কোনো জাতির ভাষায় শৃঙ্খলা না থাকলে তার চিন্তাভাবনাতেও শৃঙ্খলা থাকে না। আমি দেখি, আমাদের তরুণদের এক বড় অংশ মনের কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারে না। বিশ্বাস না হয়, টেলিভিশনে ‘তাহাদের কথা’ ধরনের অনুষ্ঠান দেখুন, যেখানে উপস্থাপক একটি চলতি বিষয়ের ওপর পথচারীদের বক্তব্য নেন। খুব কমই সঠিকভাবে একটা পূর্ণ বাক্য বলতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক দলে নাম লেখাতে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেও দেখি বাক্য শেষ করতে না পারার দুর্বলতা। ইংরেজি নয়, বাংলাতে, নিজের মাতৃভাষাতেও গুছিয়ে, সঠিকভাবে বলতে যদি ১৮-১৯ বছরের একজন শিক্ষার্থী অপারগ হয়, তাহলে বিস্ময়টা আর বিস্ময় থাকে না, ভীতিতে রূপান্তরিত হয়। এই ভাষা চর্চাকারীরা তাহলে কোন ভাষা শিখেছে? বাংলা ভাষা, নাকি ‘স্বাভাবিক’ বাংলা ভাষা?
ভাষার অনেক রূপ, সে আমরা জানি। ভাষার আঞ্চলিক রূপ থাকে, বৈঠকি রূপ থাকে; বন্ধুদের ভেতর একধরনের ভাষা চলে, পরিবারের ভেতরও। আবার ভাষার একটা প্রমিত রূপ থাকে, যা সাজিয়ে-গুছিয়ে আমাদের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানচিন্তার কথাগুলো প্রকাশ করে। এখন দেখি প্রমিত শুনলেই অনেকে লাফিয়ে পড়েন। প্রশ্ন তোলেন, প্রমিত আবার কী? আমি বলি, প্রমিত বলে কিছু নেই ধরে নিলেও প্রতিদিনের ‘স্বাভাবিক’ ভাষা দিয়ে আমরা কত দূর যেতে পারি, কতটা গুছিয়ে সব প্রকাশ করতে পারি? ইংরেজ-আরব-জাপানি-চেক, সবাই তো দেখি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে, তারা যাকে প্রমিত বলে, সেই ভাষায়। ইংরেজি, আরবিরও অনেক রূপ। কিন্তু একটা রূপকে তারা বেছে নেয় তাদের শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুলোর বাহন হিসেবে।
একসময় আমরাও নিয়েছিলাম। তখন আমরা অঞ্চলে বলতাম আঞ্চলিক ভাষা, বন্ধুদের সঙ্গে ইয়ার দোস্তির ভাষা; কিন্তু শ্রেণিকক্ষে সাহিত্য-দর্শন আলোচনায় চলত একটা প্রমিত ভাষা। সেটি পশ্চিমবঙ্গের নয়, সেটি একান্ত আমাদের। সেটি বুর্জোয়া ভাষাও নয়, যে-কেউই তা আয়ত্তে নিতে পারত। ভাষার সব রূপে যে বিরাজ করতে পারে সমান দক্ষতায়, এই ফেব্রুয়ারিতে তাকে আমার সালাম। যার কথা শুনলে ভাষার গানটা শুনতে পাই, তাকে সালাম।
৩. এখন বৈশ্বিক পুঁজির দিন। পুঁজি চায় ব্যবসা বাড়াতে। পণ্যের, সামগ্রীর, সেবার। সে জন্য চাই বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য প্রকৃত-মেকি চাহিদা সৃষ্টি করা। এবং সে জন্য চাই চমক। আর চাই একটা দেশের সব মানুষ যাতে একইভাবে পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হয়, সে জন্য একটি সাধারণ পণ্য-ভাষা তৈরি করা, যাতে অঞ্চল, শহর-গ্রাম ইত্যাদির কোনো প্রভেদ থাকবে না।
আমাদের ‘স্বাভাবিক’ বাংলা ভাষার এখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত একই রূপ। এতে পণ্য ঠাকুরদের দারুণ সুবিধা। এই ভাষা দিয়ে পশ্চিমের সব পণ্য সবখানে বিক্রি করা যাবে। লোকে ডাবের পানি ছেড়ে কোক খাবে, পিঠা ছেড়ে খাবে বার্গার।
বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। যত ভাবব, তত ভাষাকে সুন্দর করার জন্য আমরা পথ খুঁজে পাব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।