বিধাতার নাম নিয়ে আমরা যদি সবাই সত্য বলি, তবে আমরা জানি যে পরকালে আমাদের যতজনের মনে স্বর্গে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, তার চেয়েও ইহকালে ইউরোপ–আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়ার ইচ্ছা বোধ হয় কোনো অংশে কম নয়। মৃত্যু অনিবার্য এবং অবধারিত, তাই আমাদের স্বর্গলাভের আকাঙ্ক্ষাকে একরকম নিরুপায় পছন্দ হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। কিন্তু কোন সেই ভূস্বর্গ তারা ইউরোপ–আমেরিকায় রচিল, যাতে আমরা হিন্দু-মুসলমান, আস্তিক-নাস্তিক, নারী-পুরুষ, আমির-ফকিরনির্বিশেষে সেই অজানার উদ্দেশ্যে একা বা সপরিবার, কোটি টাকা জমা দিয়ে নাগরিকত্ব বানিয়ে, সেকেন্ড হোম গড়ে অথবা নৌকায় চেপে বা ফ্রিজের ভেতরে ঢুকে পৌঁছে যেতে রাজি?
সেসব দেশে সবচেয়ে বড় সুখ হলো যে যার মতো চলছে আর আমরা প্রিয় যে বাক্য সব সময় সাধারণে–অসাধারণে বলি অথচ কখনো বাস্তব জীবনে দেখিনি, সেসব দেশে তা বাস্তব হয়েছে। আইন সেখানে তার নিজস্ব গতিতে চলে। সেখানে তাই একজন দায়িত্বরত কর্মী ঘোরতর অন্যায় করে কারও পোশাক, জাতপাত নিয়ে কথা বলে বসলেও একজনের ব্যক্তিগত চ্যুতির ওই ‘সামান্য ঘটনা’কে অনলাইনে–অফলাইনে একটা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করে, তবে দোষী ব্যক্তির জন্য হালকা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হয় না। এমন ঘটনা ঘটলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তরফে নালিশ করলে সাধারণ নিয়মেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায় ওই সব দেশে।
এ দেশটায় জন্মেছি, বড় হয়েছি আর টিকে আছি যারা, আমরা তো জানি প্রতিদিন দায়িত্বরতদের কতশত অনিয়ম আমরা মাথা পেতে নিই! আমরা প্রকাশ্যে বাস থেকে চাঁদা তুলতে দেখি, একটা ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে পাঠাতেও আমাদের নানা ঘাটে খরচ করতে হয়। আমরা এগুলোকেই ‘নিজস্ব গতি’ বলে মেনে নিয়েছি। আমার মতো বাংলাদেশের রাস্তায় হেঁটে যে মেয়েরা বুড়ো হয়েছেন, তাঁরা তো জানেন পোশাক, শরীর সব নিয়েই বয়স–পেশা–অবস্থাননির্বিশেষে রাস্তার পুরুষ কী ধরনের মন্তব্য নির্বিকার এবং প্রায়ই দলবদ্ধভাবে করতে থাকেন। নারী জানেন, সারা শরীর মুড়েও সে এই চোখ ও মুখের অত্যাচার থেকে বাংলাদেশের জনপরিসরে মুক্তি পায়নি। তাহলে যে চোখের পর্দা করতে বলল ধর্ম, তা কি তবে আমাদের পেছনে ফেলে ‘বিধর্মী ইহুদি নাসারা’রা বেশি পালন করে দেখিয়ে দিচ্ছে?
কয়েক দিন আগে দেখলাম এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণার শিরোনাম হয়েছে, ৭৪ শতাংশ মানুষ ভাবেন সমাজের জন্য মন্দ মেয়েরা মন্দ ছেলেদের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক! (পৃষ্ঠা ৩, প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০২২) আর মন্দ মেয়ে হচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা নাইট শিফট করেন, গণমাধ্যমে কাজ করেন, পুরুষের সঙ্গে কাজ করেন। দেখুন, ওই যে ইউরোপ–আমেরিকা আমরা হতে চাই, তাদের দেশে কিন্তু মেয়েরা তাদের পছন্দমতো পোশাক পরে (ওই গবেষণায় যাকে বলছে পশ্চিমা সংস্কৃতির পোশাক!) রাস্তায় হাঁটছে, নাইট শিফট করছে, অথচ ওই মূর্তিমান ‘মন্দ মেয়ে’দের দেশে বাসে উঠলেই চিমটি নেই, রাতে বের হলেই ধর্ষণ নেই, থানা-পুলিশ বা সমাজে ‘রাতে বের হলি কেন?’ সে প্রশ্ন নেই। অর্থাৎ বিধর্মীদের দেশে অধর্ম নিশ্চিতভাবেই কম!
আর এ দেশে ২০২২ সালে সহিংসতার কারণ অনুসন্ধানের ‘গবেষণা’য় দেখা যাচ্ছে, যে মেয়েরা বাইরে কাজে যায় তাদের সমাজ ‘মন্দ মেয়ে’র কাতারে ফেলছে। ‘গবেষণা’ করে এই তথ্য জানতে পারছি যে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার মেয়েদের নিজেদেরও দোষ আছে বলেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করে! কিন্তু ভুলে যাচ্ছি, আরও ১০ বছর আগের সরকারি গবেষণাতেও প্রমাণ আছে, দেশের নারীদের ৮৫ শতাংশের বেশি তাঁর স্বামীর গৃহে (নিজ গৃহ বলব কি?) নির্যাতনের শিকার হন। অর্থাৎ এমনকি বাড়িকেও আমরা নারীর জন্য নিরাপদ করতে পারিনি।
আমাদের অনুভূতির সহ্যশক্তি বাড়াতে হবে। ‘মন্দ মেয়ে’ খোঁজা বাদ দিয়ে নিজেদের ভালো মানুষ হতে হবে। কারণ, আজকের দুনিয়ায় শুধু নারী নয়, পুরুষের শরীরে নারীর মনধারী আর নারীর শরীরে পুরুষের মনধারী মানুষকে চাইলেই ঢিল দিয়ে কিংবা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা যায় না। ধার্মিকেরা মানেন, টিপ পরা কিংবা হিজাব পরা নারী দুই–ই স্রষ্টার অমূল্য সৃষ্টি আর আইন বলে, ধনী–গরিব, নারী-পুরুষ, মুসলিম–অমুসলিম কারও নিজের মতো বাঁচার অধিকার কারও চেয়ে কম নয়।
অথচ এসব তর্ক আমাদের অনুভূতিকে আঘাত করে। কারণ, মন্দ মেয়ের ধারণাটি হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস আর কুমিল্লার বোরকাবৃত তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা কিংবা অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাগুলো হলো প্রমাণ। বিশ্বাসকেই জোর করে বাস্তবিক প্রমাণ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা গায়ের জোরে কিংবা ইনিয়ে-বিনিয়ে এখনো বন্ধ করতে পারেনি আমাদের সমাজ। অথচ সভ্য সমাজে বিশ্বাস ব্যক্তিগত আর প্রমাণ স্বতঃসিদ্ধ।
আমাদের বোধ হয় জিজ্ঞেস করার সময় এসেছে, এই যে কখনো টিপ, কখনো মন্দ মেয়ে, কখনো স্কুলের ছাত্রীদের পোশাক নিয়ে গুজব, কখনো ধর্ম না বিজ্ঞান এই যাবতীয় তর্ক উঠিয়ে আর তাতে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ এমনকি কোনটা সর্বশক্তিমানের সবচেয়ে পছন্দ, সে বিষয়ে আমরা রায় দিচ্ছি তা এ জন্য নয়তো যে আসলে পুরো সমাজটাই জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে চলছে? দোষ কাকে দেব, তা না বুঝতে পেরেই কি সারাক্ষণ নন্দ ঘোষকে খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে?
আমাদের অনুভূতির সহ্যশক্তি বাড়াতে হবে। ‘মন্দ মেয়ে’ খোঁজা বাদ দিয়ে নিজেদের ভালো মানুষ হতে হবে। কারণ, আজকের দুনিয়ায় শুধু নারী নয়, পুরুষের শরীরে নারীর মনধারী আর নারীর শরীরে পুরুষের মনধারী মানুষকে চাইলেই ঢিল দিয়ে কিংবা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা যায় না। ধার্মিকেরা মানেন, টিপ পরা কিংবা হিজাব পরা নারী দুই–ই স্রষ্টার অমূল্য সৃষ্টি আর আইন বলে, ধনী–গরিব, নারী-পুরুষ, মুসলিম–অমুসলিম কারও নিজের মতো বাঁচার অধিকার কারও চেয়ে কম নয়।
যে দেশগুলোকে স্বর্গ মেনে যাওয়ার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি, তারা সেগুলো নিশ্চিত করে ফেলেছে। সে কারণেই সেখানে ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা ‘হোমলেস’ মানুষকেও কোনো বড় মানুষের ছেলে হঠাৎ পাজেরো তুলে পিষে মারতে পারে না। ওদের গণপরিবহনে মেয়র, মন্ত্রীরা উঠে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক কাতারে বসে বা দাঁড়িয়ে যান। সেখানে কোনো নারীকে শুনতে হয় না পাবলিক বাসে উঠলে চিমটি তো খেতেই হবে। দুনিয়ার স্বর্গের চেহারাটা কেমন তা যেহেতু আমরা জানি, সেসব জায়গাতেই পালিয়ে বাঁচতে চাই অথবা ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিতে চাই, কাজেই পরকালের স্বর্গের প্রত্যাশায় আপাতত নিজেদের দেশটাকে নরক বানানো তাহলে বন্ধ করি?
আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমাদের অতটুকু সুবুদ্ধি আর সাহস হবে যে আমরা বলব, ‘মন্দ মেয়ে’ নয়, বরং সব ধর্মের সব সুশাসন ভেস্তে দিয়ে যে মানুষেরা ঘুষ খায়, গরিবের ওপর অত্যাচার করে, পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তির ভাগ দেয় না, তারাই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এর আগে চলুন নিজেদের বানানো নরকে বসে ইহকাল–পরকালের স্বর্গসুখ কল্পনা করতে থাকি।
● নবনীতা চৌধুরী সংবাদ বিশ্লেষক এবং ব্র্যাকের পরিচালক