ভারসাম্যের টানাপোড়েন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর সরকারের যাত্রার শুরুতে পাশে ছিল শুধু ভারত। ফলে সরকারের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার স্বীকৃতি আদায় ছিল সে বছরের প্রথম মাসগুলোতে কূটনীতিকদের প্রধান কাজ। মেয়াদের শেষ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, বৃহৎ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাই কূটনৈতিক অঙ্গনে সরকারের অন্যতম প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে।
ভারতের পর চীন, রাশিয়া ও জাপানের মতো অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে। বাংলাদেশ চীনের ‘এক অঞ্চল ও এক পথ’ আর জাপানের ‘বিগ বি’র মতো বৃহদায়তন উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যুক্ততার অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করেছে বাংলাদেশ।
১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলা বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বড় পরিসরে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এরপর থেকে জঙ্গিদের অবস্থান, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি নানা কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সফর বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমা কূটনীতিকেরা পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় আনা বন্ধ করেন। নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি অব্যাহত রাখায় নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে যায় বাংলাদেশ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান, নিরাপত্তা বাড়ানোসহ অভ্যন্তরীণ নানা পদক্ষেপে বেশ কয়েক মাস পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যদিও ব্যবসায়ী মহলের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ কখনো কখনো এখানে জঙ্গিদের উপস্থিতি নিয়ে তাদের আশঙ্কা করে থাকে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা সংকট, যা একটি বৈশ্বিক রূপ নিয়ে বাংলাদেশকে এক অভাবনীয় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ, মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। এর ওপর ভর করে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর—এই তিন মাসে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় মাত্রা যখন যেটাকে দরকার, সেটাকেই সামনে এনেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, সামুদ্রিক অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ জোরালো। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান দৃশ্যমান না হলে রোহিঙ্গা সংকটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাদে প্রায় সব আন্তর্জাতিক পক্ষকে এভাবে পাশে পাওয়া সম্ভব হতো না।
তবে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক শক্তিকে পাশে পেলেও প্রতিবেশী ভারতের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশকে রোহিঙ্গা সংকটে সেভাবে পাশে পায়নি বাংলাদেশ। প্রকাশ্যে রাজনীতিবিদদের মতো কূটনীতিকেরাও এসব দেশের সহযোগিতা পাওয়ার কথা বারবার বলেছেন। অথচ এই তিন দেশই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মানবিক ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেনি। নিকট-প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোর সম্পর্কের বিশেষ মাত্রার কারণে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা হতাশা আছে বাংলাদেশের।
রোহিঙ্গা সংকটে চীনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় চীনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের। চীন এটা বেশ ভালোভাবেই জানে বলে রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের দিকেই ঝুঁকে ছিল। কারণ, মিয়ানমারে জাতিসংঘের কোনো হস্তক্ষেপ চীন মেনে নেবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতও পাশে থাকবে, এটা চীন বুঝেছে। এ প্রক্রিয়ায় রাশিয়াকে সঙ্গে রেখেছে চীন।
গত চার বছরের পরিসরে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের বড় জায়গাজুড়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পর্ক বাড়লেও গত কয়েক বছরে একটা জায়গায় গিয়ে থমকে আছে। এরপরও প্রতিরক্ষা, সন্ত্রাস দমন, উন্নয়ন সহায়তার মতো অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে সম্পর্ক সম্প্রসারিত হলেও সব সময় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলেছে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক। অতীতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি ডেমোক্র্যাটদের পক্ষপাতিত্বের কারণে নাগরিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদি প্রশ্নে টানাপোড়েন হয়েছে দুই দেশের সম্পর্কে। তবে ২০১৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকায় এসে তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন ও সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করেন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা। এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের প্রতিফলন বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। ২৮ দেশের এই জোটের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলেও শ্রমিক অধিকারের বিষয়টির তেমন সুরাহা হয়নি। ফলে বারবার বিষয়টি এসেছে। আর শ্রমিক অধিকারের সুরাহা না হলে ভবিষ্যতে বাণিজ্য সম্পর্কে তা প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনী বছরে শ্রমিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশকে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ফলে এ বছরের প্রথম প্রান্তিক বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের।
ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈতরণি ২০১৭ সালে সফলভাবে পার হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের শুরু থেকেই অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরানোর জন্য চাপ ছিল। বাংলাদেশকে চুক্তি করতে খসড়া দিলেও প্রায় দেড় বছর নানাভাবে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরে চুক্তিটি সই করেছে বাংলাদেশ। তবে এতে বাংলাদেশ এটা নিশ্চিত করেছে যে ফিরে আসা লোকজনের পুনর্বাসনে উন্নয়ন সহায়তা দেবে ইইউ।
ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দুই প্রস্তাবকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বাংলাদেশ। কারণ, ওই প্রস্তাব দুটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ইউরোপের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। ব্রাসেলসে ইইউ সদর দপ্তর এবং স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নিবিড় যোগাযোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে বলে কূটনীতিকেরা মনে করেন।
চিরাচরিত শ্রমবাজারকেন্দ্রিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, ব্যবসার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন হামলায় সমর্থন, আইএসবিরোধী সৌদি জোটে যোগ দিয়েও অস্ত্র হাতে নেয়নি বাংলাদেশ। আবার ইরান ও কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরিতায় নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে বাংলাদেশ। রিয়াদের অব্যাহত চাপের পরও আইএসবিরোধী জোটে সৈন্য পাঠানো, ইরান ও কাতার প্রশ্নে ঢাকা স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সফল হয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কে একধরনের গুণগত পরিবর্তন আনতে পেরেছে বাংলাদেশ।
গত চার বছরে ভারতের পাশাপাশি চীন ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ মাত্রায় নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে মনোযোগী হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করার ক্ষেত্রে ভারত ও জাপানের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার কথা বাংলাদেশকে ভাবতে হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের পথে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা, অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ আর অবকাঠামো উন্নয়নের কথা ভেবে চীন ও জাপান বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছে। দুই দেশই বাংলাদেশের বৃহদায়তনের প্রকল্পগুলোতে যুক্ত হয়েছে। আবার চীন এক অঞ্চল ও এক পথ আর জাপান বিগ বির মতো উদ্যোগে যুক্ত করেছে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ‘উন্নয়ন সহযোগিতার কৌশলগত সম্পর্ক’ আর দুটি সাবমেরিন কেনার পর ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সই ও ঋণ চুক্তিতে অস্ত্র কিনতে হয়েছে। বড় শক্তিগুলোকে পাশে পেতে গিয়ে বাংলাদেশ কতটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, সেটা সময় বলে দেবে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে তিন ঋণচুক্তিতে ৮ বিলিয়ন ডলার, চীনের কাছ থেকে ২২ চুক্তিতে ৪০ বিলিয়ন ডলার সামলানোর সক্ষমতা আমাদের আছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আর কূটনীতির বড় জায়গাজুড়ে আছে ভারত। একতরফা নির্বাচনে জোরালো সমর্থনের কারণে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পাঁচ মাসের মাথায় ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে স্বল্প সময়ের জন্য সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে সংশয় ছিল। বিজেপি সুষমা স্বরাজকে ঢাকায় পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতার যতই পালাবদল হোক, কংগ্রেসের ধারাবাহিকতায় সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। তাই ২০১৫ সালের জুনে ঢাকায় আসার আগে ভারতের সব দলকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত চুক্তির সুরাহা করেন নরেন্দ্র মোদি। তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য সময় চাইলেও ২০১৭-তে নরেন্দ্র মোদি তা করতে পারেননি। এখন দেখার আছে দুই সরকারের বর্তমান মেয়াদে সেটি হচ্ছে কি না। মোদি বলেছেন, শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান মেয়াদে চুক্তিটি করবেন।
বাংলাদেশের চার বছরের কূটনীতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায়, বৈদেশিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, হোলি আর্টিজান-পরবর্তী নাজুক ভাবমূর্তি, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য, সৌদি আরব আর ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই আমরা অ্যাডহক ভিত্তিতে চলেছি। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এভাবে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিয়ে কতটা এগোনো যাবে, সামনের দিনগুলোতে সেটা বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিতে পারে।
রাহীদ এজাজ: কূটনৈতিক প্রতিবেদক, প্রথম আলো