ভারতের 'হ্যাশট্যাগ মিটু'-ঝড়
জ্যোতি সিংকে চেনেন কি না জানতে চাইলে এখনো ভারতে অনেকের ভ্রু কুঁচকে উঠতে পারে। কিন্তু ‘কে জ্যোতি, কেন জ্যোতি’ প্রশ্নটা আপনাকে মোটেই শুনতে হবে না, যে মুহূর্তে ‘জ্যোতি’ নামটা পাল্টে হয়ে যাবে ‘নির্ভয়া’। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের রাতে রাজধানী দিল্লিতে যে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল, যা তোলপাড় করে দিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতির শাসক ও বিরোধী দলের কেষ্ট-বিস্টুদের, যেখান থেকে জন্ম ‘নির্ভয়ার’, ক্রমে সেটাই কিন্তু জন্ম দিয়েছিল নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস। জন্ম হয়েছিল এক আন্দোলনের।
‘নির্ভয়া’ সেদিক থেকে এক মাইলফলক। সম্ভবত তেমনই আরেকটা মাইলফলক হতে চলেছে দেশজ ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলন।
সেই কোন আদ্দিকালে ইন্দ্রপ্রস্থে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল। আজ যেখানে দিল্লি, সেকালে ইন্দ্রপ্রস্থর অবস্থান ছিল এই তল্লাটেই। সেই থেকে এই আজ পর্যন্ত ‘অমিত শক্তিধর’ পুরুষের হাতে ‘অবলা অথবা সবলা’ নারীর নির্যাতনের কাহিনি পল্লবিত হতে হতে ‘স্বাভাবিকতার’ তকমা পেয়ে গেছে। কেউ দোষী ঠাওড়েছে স্বল্পবসনা নারীকে। কেউ বলেছে, ওই অপকম্ম ছেলেদের সামান্য ভুল। ক্ষমাঘেন্নাযোগ্য অপরাধ। কেউ অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে নারীর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে। কেউবা বলেছে, রাত করে বাড়ি ফেরার দরকারটা কী? নির্যাতনের ঘটনা পরিবারের মধ্যেই ধামাচাপা দেওয়ার রেওয়াজ আজও প্রবল। আজও পরিবারের মাথারা চুপি চুপি নিজেদের অদৃষ্টকে দায়ী করে পারিবারিক সম্মান রক্ষায় তাড়নায় মৌনতাকে আঁকড়ে ধরতে পছন্দ করেন। ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রণালয় নির্দ্বিধায় মেনে নেয়, নির্যাতনের যত অভিযোগ থানায় জমা পড়ে, তার কয়েক গুণ বেশি অজানাই থেকে যায়। পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের চোখে অপাঙেক্তয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং নির্যাতনের শিকার নারীর ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে পরিবারের কর্তারা মুখে কুলুপ আঁটেন। কোথাওবা অপরাধ চাপা দেওয়ার ‘সওদা’র শর্ত মানতে বাধ্য হন।
নির্ভয়া-কাণ্ড সেদিক থেকে মাইলফলক এই কারণে, সারা দেশে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমে সরকারকে বাধ্য করেছিল শাস্তির বহর কঠোর করে তুলতে। আজ ভারতে আইনের চোখে নাবালকদের সাবালক বলে গণ্য করে শাস্তি দেওয়ার যে গরজ আদালত দেখাচ্ছেন, নির্ভয়া-কাণ্ড না ঘটলে তা কবে ঘটত কেউ জানে না। সেদিক থেকে ওই ঘটনাকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ অথবা ‘আরব স্প্রিং’-এর সঙ্গে তুলনা করলে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়বে না।
বিখ্যাত প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টিইনের যৌন নির্যাতনের শিকার যেসব নারীর অভিযোগ থেকে আজ ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলনের জন্ম, ভারতে তার শাখা বিস্তারে খুব একটা বেশি সময় কিন্তু লাগেনি। এত দিন ধরে বিক্ষিপ্তভাবে একটি-দুটি অভিযোগ মিডিয়ায় সামান্য ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেছে। সেসব অভিযোগ প্রধানত ছিল চলচ্চিত্রসহ বিনোদনের জগতের কুশীলবদের ঘিরে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অদম্য তাগিদ সর্বস্ব নারী কীভাবে ‘কাস্টিং কাউচ’দের শিকার হয়েছেন, কেউ কেউ ভাসলেও কীভাবে অনেক বেশি নারী তলিয়ে গেছেন গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের অতলে, সেসব কাহিনি নিভৃতে পল্লবিত হলেও জনজীবনে ঢেউ তোলেনি। যাঁরা সফল, তাঁদের কেউ কেউ গ্লানিময় অতীত ভুলে যেতে চেয়েছেন। কেউ স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন, কেউবা বাধ্য হয়ে। কত সিনেমা হয়েছে এই নিয়ে। অভিযোগও যে ওঠেনি তা নয়। কিন্তু একা নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দমিয়ে দিয়েছে পুরুষ-শাসিত বিনোদনের জগৎ। কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়ার অলিখিত শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে এই দুনিয়ার দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত নারীকুল, আজও যাঁরা পুরুষের তুলনায় কোনো ক্ষেত্রেই সমানাধিকার আদায় করতে পারেননি। সেদিক থেকে বিরল হয়ে থাকবেন বাঙালি তনয়া তনুশ্রী দত্ত।
বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, তনুশ্রীই আজকের ভারতের ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলনের জননী। তাঁর সাহস কুর্নিশযোগ্য।
তনুশ্রীর বয়স মাত্র ৩৪। দশ বছর আগে ২৪ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের গ্ল্যামারকে নীরবে বাই বাই করে তিনি মার্কিন মুলুকে চলে যান। তনুশ্রীর জন্ম সেই সময়, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজনীতির শীর্ষে তারুণ্যের জয়গানের শুরু রাজীবের সেই উত্থানের কিছু আগে যখন তাঁর ভাই সঞ্জয় দেশে অন্য এক রাজনৈতিক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন। শৈশব ছেড়ে তনুশ্রীর কৈশোরাবস্থা শুরুর সময় থেকে নরসিংহ রাওয়ের হাত ধরে ভারতের অর্থনৈতিক নবজাগরণ মাথা তুলতে থাকে। উদার অর্থনীতি ক্রমে দেশ ও সমাজকে বদলে দিতে শুরু করে তনুশ্রীর যৌবনের প্রারম্ভ থেকে। তত দিনে জন্ম হয়েছে নতুন নতুন মূল্যবোধের। হুট করে খুলে গেছে নতুন এক দুনিয়ার দরজা-জানলা। বেড়ে গেছে কর্মসংস্থান ও রোজগারের ব্যাপ্তি ও পরিধি। উন্নয়নশীল ভারতের নাগালে দ্রুত এসে গেছে উন্নত দুনিয়ার ঔজ্জ্বল্য। মধ্যবিত্তের আড়ষ্টতা ঝরতে শুরু করেছে। পশ্চিমা আধুনিকতা গ্রাস করে চলেছে প্রাচ্যকে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন শ্রেণির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের চোখে নতুন বৈভবের হাতছানি। প্রথার ধারাবাহিকতা অস্ত গিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন জীবনবোধ। দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে নিমেষে। ‘বোকা বাক্স’ দুনিয়াকে আগেই হাজির করেছিল বৈঠকখানায়, সহজলভ্য প্রযুক্তি তার পাশাপাশি মেলে ধরল তার ডানা। ক্রমেই সর্বার্থে ঘুচতে থাকে পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী দূরত্ব। নারীর প্রতিটি পদক্ষেপে ঝরতে শুরু করে আত্মবিশ্বাস ও আস্থা। তনুশ্রীর সাহস সেই পদক্ষেপগুলোয় জুগিয়েছে বাড়তি সাহস। ষাঁড়ের শিং ধরে মোকাবিলার সাহসী দৃষ্টান্ত আজ তিনি দেখাতে পারলেন। প্রায় প্রতিদিন তাই যেমন বাড়ছে তাঁর প্রতি সমর্থনের বহর, তেমনই বেরিয়ে আসছে একের পর এক অসম্মানের কাহিনি। ভেসে উঠছে বিভিন্ন পেশার সফল ও পরিচিতদের অপরিচিত মুখ। খসে যাচ্ছে মুখ ও মুখোশের ছলচাতুরী।
নতুন এই যুগের শর্ত মেনে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বাধ্য হয়েছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে। দেশের প্রতিটি সংস্থার কাছে ওই বিভাগ রাখা বাধ্যতামূলক। লোকলজ্জা ও সামাজিক ভয়ের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সচেতন নারী (কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষও) আজ অভিযোগ দায়ের করতে পিছপা হচ্ছে না। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, যৌন হয়রানির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি জমা পড়েছে উইপ্রো, ইনফোসিস, টাটা কনসালটেন্সির মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোয়। আইসিআইসিআই, অ্যাক্সিস বা কোটাক মাহিন্দ্রর মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলো সেই তালিকায় দ্বিতীয়। সরকারি সংস্থাগুলোয় অভিযোগ জমা পড়েছে তুলনামূলকভাবে কম। সার কথা এই, যৌন হয়রানি ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন কমছে; যেমন কমছে লোকলজ্জার ভয়ে মুখ বুজে অপমান সহ্য করার সংখ্যা। দেশের গ্রামগঞ্জের থানাতেও আজ জমা পড়ছে নির্যাতনের অভিযোগ।
‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? এখনই সে কথা বলার সময় আসেনি। তনুশ্রী বলটাকে গড়িয়ে দিয়েছেন। অপরাধীদের ক্ষমাপ্রার্থনার বহর বাড়ছে। আইনও বসছে নড়েচড়ে। আপাতত এটুকু বলা যেতেই পারে, শিক্ষিত নারীরা আজ আরও বেশি সচকিত ও উজ্জীবিত। অবলা থেকে রূপান্তরিত সবলায়। বাকিটা আইন, সরকার ও জনচেতনার দৃঢ়তার হাতে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি