দিন কয়েক ধরে ভারতে বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব উঠেছে। ড্রয়িংরুমগুলোর সান্ধ্য মজলিশ গমগম করছে। টেলিভিশন চ্যানেলের কোনো খামতি এই দেশে নেই। গণতন্ত্রের বিকাশ যে কী বিপুল, অসংখ্য চ্যানেল তার একটা প্রমাণ। ফি দিন সন্ধ্যায় এগুলোর প্রতিটিতে জমজমাট আলোচনা হচ্ছে। পাকিস্তানকে কীভাবে সবক দেওয়া যায়, তার হরেক রকম ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে। দেখেশুনে মাঝে মাঝে মনে হয়, আলোচনার কুশীলবদের কারও কারও হাতে ভারতের ভাগ্য থাকলে বিশ্বের মানচিত্র থেকে পাকিস্তান এত দিন হয়তো মুছে যেত।
সুখের কথা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সব দাবিতে গা ভাসাননি। তবে নেতৃত্ব যে হাতে চুড়ি পরেও বসে নেই, তা বোঝাতে নিয়ন্ত্রণরেখার ওধারে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী একটা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ হেনেছে। ভারতের দাবি, সেই অভিযানে সাত-সাতটি জঙ্গি শিবির ও তাদের ‘লঞ্চিং প্যাড’ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ৩৫-৪০ জন সন্ত্রাসী ও তাদের গাইড নিকেশ হয়েছে। নিহত হয়েছে জনাকয়েক পাকিস্তানি জওয়ানও। শুধু তা-ই নয়, অভিযান শেষে সেই খবরটা ভারতের ডিজিএমও পাকিস্তানি ডিজিএমওকে জানিয়েও দিয়েছেন। তারপর ঘটা করে সেই সংবাদ প্রচার করা হয়। হকচকিত পাকিস্তান তার চিরবৈরী প্রতিবেশীর এই দাবি নস্যাৎ করে বলেছে, যা হয়েছে তা নিছকই নিয়ন্ত্রণরেখার ওপার থেকে গোলাগুলি বর্ষণ। তাতে জনাদুয়েক জওয়ান নিহত হয়েছে এই যা। তারা বলেছে, উপযুক্ত জবাব দিতে তারাও প্রস্তুত। দুপক্ষের কে কতটা ঠিক বা ভুল, তার চটজলদি কোনো প্রমাণ এই মুহূর্তে নেই। যদিও ভারতীয় সেনানীরা বলছেন, গোটা অভিযানই ক্যামেরাবন্দী করে রাখা হয়েছে। ঠিক সময়ে তা প্রকাশ করা হবে। তত দিন পর্যন্ত চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হচ্ছে না।
দাবি ও পাল্টা দাবির এই চাপানউতরের বাইরে যেটা স্পষ্ট তা থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তানকে একঘরে করার যে কথাটা নরেন্দ্র মোদি উরি হামলার পরপরই বলেছিলেন, বেশ গুছিয়েই সেই রাস্তায় তিনি হাঁটা শুরু করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সেই লড়াইয়ে এই মুহূর্তে তিনি বড় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন বাংলাদেশ, ভুটান ও আফগানিস্তানকে। নভেম্বরে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নরেন্দ্র মোদি নিয়েছেন, সেই একই সিদ্ধান্ত একই দিনে নিতে দ্বিধান্বিত হননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। দুই দেশের সম্পর্ক আজ কতটা ঘনিষ্ঠ, এই সিদ্ধান্ত তার একটা বড় উদাহরণ।
প্রয়াত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের ‘দ্য থিওরি অব থাউেজন্ড কাটস’ তাঁর উত্তরসূরিরা যে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছেন, আজকের কাশ্মীর তার প্রমাণ। পাঞ্জাবের খলিস্তানি আন্দোলন ভারতকে বেশ কিছুটা রক্তাক্ত করলেও শেষ হাসি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতই হেসেছে। কিন্তু জিয়ার তত্ত্ব তারপরও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে কাশ্মীরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আইএসআই ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে তো চলেছেই। এ এক অন্তহীন যুদ্ধ। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত চার-চারটি যুদ্ধ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত লড়েছে। এগুলোর তিনটি জম্মু-কাশ্মীরের বুকে, চতুর্থটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু ১৯৯৮-এর দ্বিতীয় পোখরান এবং প্রায় একই সঙ্গে পাকিস্তানের চাঘাই পরমাণু পরীক্ষা শক্তির তারতম্য দূর করে দুই দেশকে এক কাতারে দাঁড় করায়। পরমাণু শক্তিধর হয়েও সারা বিশ্বে দায়িত্বজ্ঞানের যে পরিচয় ভারত রাখতে পেরেছে, দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান সেই ভরসা পৃথিবীকে দিতে পারেনি। এর প্রথম কারণ, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়া। দ্বিতীয় কারণ, সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের ওপর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ অধিকার স্থাপিত না হওয়া এবং তৃতীয় কারণ উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর দিন দিন মাথাচাড়া দেওয়া। দেশের এক বিস্তীর্ণ এলাকা এই সন্ত্রাসীদের মুক্তাঞ্চল। সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনী নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেই চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান। সন্ত্রাসীদের হাতে তা যে পড়েনি বা পড়বেও না, সে বিষয়েও এই মুহূর্তে কেউ ১০০ শতাংশ নিশ্চিত নয়।
এই প্রেক্ষাপট বিচার করলে পাঠানকোট বা উরির যোগ্য জবাব যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নয়, ভারতের নীতিনির্ধারকেরা তা উপলব্ধি করেন। দায়িত্বজ্ঞানশীলতার পরিচয়ও এটাই। ফলে ‘দাঁতের বদলে পুরো চোয়াল খুলে নেওয়া’ কিংবা ‘পরমাণু যুদ্ধ হলে ১৯ কোটি পাকিস্তানির সঙ্গে ৫০ কোটি ভারতীয় শেষ হয়ে গেলেও আরও ৭০ কোটি বেঁচে থাকবে’, এ-জাতীয় হুংকারকে ভারতীয় নেতৃত্ব আমল দেয়নি। কিন্তু তবু আমরা ‘রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না’ মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর মুখে শুনেছি। রাষ্ট্র পরিচালনায় এটি স্বাভাবিক। তাঁকেও তো দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে হবে। বরাভয় দিতে হবে। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ তারই নমুনা।
কূটনৈতিক স্তরে পাকিস্তানকে একঘরে করতে ভারত যে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো কিছুটা যে কাজ দিয়েছে, তা পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট। দ্বিপক্ষীয় কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ। উপমহাদেশের অধিকাংশ দেশও যে ভারতের পাশে, সার্ক-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তার বড় প্রমাণ। সিন্ধু চুক্তির পর্যালোচনাও পাকিস্তানকে বেশ চিন্তায় ফেলেছে। অথচ একতরফাভাবে চুক্তি রদ করার কথা ভারত বলেনি। বলবেও না। যদিও দেশের কট্টরপন্থীরা সে জন্য চাপ বাড়িয়েই যাচ্ছে। চুক্তির মধ্যে থেকেও যেসব পদক্ষেপ ভারত নিতে পারে, পাকিস্তানকে অস্বস্তিতে ফেলার পক্ষে তা যথেষ্ট। সেই অস্বস্তির কারণেই পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের দরজায় কড়া নেড়েছে। আরবিট্রেশনে যাওয়ার কথাও ভাবছে। পাকিস্তান বিলক্ষণ বুঝেছে, সিন্ধুর এই জলযুদ্ধ সত্যি সত্যি শুরু হলে ভারতের ভাগ্যে কী থাকবে তা পরের কথা, তবে তাদের দুর্ভোগ হবে অন্তহীন। ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন’-এর তকমা পাকিস্তানের ললাট থেকে ভারত মুছে দেবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন। যদিও এতে পাকিস্তানের লোকসান সামান্যই। কারণ, বার্ষিক পৌনে তিন বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানি বড়জোর ৫০০ মিলিয়ন। তবে একঘরে করে দেওয়ার এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ভারত যদি তার আকাশপথ পাকিস্তানি বিমানের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তারই পাশাপাশি বেলুচিস্তানের নির্বাসিত নেতা ব্রহ্মদাগ বুগতিকে ভারতে থাকার অনুমতি দেয়, চাপ তাহলে আরও বাড়বে।
এসবের বাইরে ভারত আর যে জিনিসটা করতে চাইছে, জাতিসংঘকে দিয়ে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা, তা কতটা সফল হবে বলা কঠিন। কারণ, এখনই এতটা কড়া পদক্ষেপ নিতে বড় শক্তিগুলো রাজি নয়। তা ছাড়া এটা মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানও একেবারেই বন্ধুহীন নয়। উরি হামলার নিন্দা করলেও আমেরিকা কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি নয়। ভারতের আর এক মিত্র দেশ রাশিয়া। আপত্তি সত্ত্বেও তারা কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ সেনা মহড়ায় নেমেছে। পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ইরান আবার বলেছে, তারা প্রস্তাবিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) সঙ্গে চাবাহার বন্দরের সংযুক্তিতে আগ্রহী। ভারত এই করিডরের বিরোধিতা করে চলেছে। ‘ওআইসি’ দেশসমূহ কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে। পাকিস্তানের অনুরোধ মেনে ওআইসির মানবাধিকার কমিশনের প্রধান তুরস্ক বলেছে, তারা কাশ্মীরে তথ্যানুসন্ধান দল পাঠাতে রাজি। নেপাল এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পোক্ত করার আগ্রহ দেখিয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানি উরি হামলার পর সন্ত্রাসী কাজকর্মের নিন্দা ও সমালোচনা করলেও পাকিস্তানের নাম তারা করেনি। সবার ওপরে রয়েছে তাদের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু চীন। ভারতের সঙ্গে যেকোনো দুশমনিতে যারা পাকিস্তানের পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের রসায়ন যখনই গুলিয়ে যায়, তখনই কিছু অর্বাচীন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তারা কখনো শিবসেনা, কখনো তাদেরই ভগ্নাংশ মহারাষ্ট্র নব নির্মাণ সেনা, কখনোবা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী অজ্ঞাত কুলশীল কোনো সংগঠনের নামই বহন করে। এরা কখনো দুই দেশের ক্রিকেট বন্ধ করার ফরমান জারি করে, কখনো পিচ খুঁড়ে খেলা ভন্ডুল করে দেয়, কখনোবা হুমকি দেয় পাকিস্তানি শিল্পী ও কলাকুশলীদের ভারতে কাজ করতে দেওয়া হবে না। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেই হুমকির ফলে কেউ কেউ ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। বেশ কয়েকজন শিল্পীর অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
এগুলো কিন্তু মোটেই কাজের কাজ নয়। শিল্পী ও কলাকুশলীরা মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলই ঘটিয়ে থাকেন, বিচ্ছেদ নয়। পাকিস্তানের এই মানুষজন এবং তাঁদেরই মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষ সব সময়েই দুই দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিক ছন্দে দেখতে চেয়েছেন। তাঁদের ওপর রাগ দেখানোর অর্থ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের ফাঁদে পা দেওয়া।
এই সেদিনও যিনি ছিলেন হাতে-হাত ধরা বন্ধু, যাঁর আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে আফগানিস্তান থেকে দিল্লি ফেরার পথে নরেন্দ্র মোদি টুক করে ইসলামাবাদে নেমে তাঁর বাড়ি চলে গিয়েছিলেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেই নওয়াজ শরিফের সঙ্গে তাঁর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। শুধু তা-ই নয়, সৃষ্টি হয়ে গেল যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতিরও! অথচ গোটা পৃথিবীরই জানা, পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের দণ্ডমুণ্ডের একমাত্র কর্তা নন। তাঁকেও নিরন্তর একটা লড়াই চালাতে হয় তাঁরই দেশের সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে, সন্ত্রাসী দলের চাঁইদের সঙ্গে, সে দেশের সরকারের ছকবাজ ও অর্বাচীনদের সঙ্গে। পাকিস্তানকে চাপে রেখে তাদের নির্বাচিত সরকারকে দিয়ে এসব অশুভ ও অবাঞ্ছিত শক্তির রাশ টানাই ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেখা যাক, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, তার প্রত্যুত্তর ও কূটনৈতিক চাপের পরিণতি কী হয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।