ভারতের সিএএ: শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলেছেন, অযৌক্তিক কি?
ভারত কেন নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তা বোধোগম্য হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বুঝছি না, (ভারত সরকার) এটা কেন করল। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
প্রথম আলোয় ২০ জানুয়ারি এই যে খবরটা প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে, তা আসলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) গালফ নিউজ পত্রিকাকে দেওয়া হাসিনার এক সাক্ষাৎকারের নির্যাস। সম্প্রতি ওই দেশ সফরের সময় ওই কাগজকে দেওয়া হাসিনার এই মন্তব্য ভারতের প্রায় সব প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন্তব্যটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রথমত, ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা ‘সিএএ’ এবং তারই সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা ‘এনআরসি’ নিয়ে বাংলাদেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বাংলাদেশ বারবার তাদের এই দুশ্চিন্তার কথা ভারতকে জানিয়েছে। ভারতও প্রতিবার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেছে, ওটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশঙ্কামুক্ত হতে পারেনি নানা ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্যের জন্য।
দ্বিতীয়ত, সিএএ ও এনআরসি প্রসঙ্গে হাসিনার ওই মন্তব্য (প্রকাশ্যে এই প্রথম) ভারতের সরকারি সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হাসিনা স্পষ্ট বুঝিয়েছেন, এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। প্রয়োজন কেন ছিল না, সেই ব্যাখ্যায় তিনি যাননি। কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার ও ‘সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়ের’ দরুণ সেই ব্যাখ্যা তিনি ঊহ্য রাখতেই পছন্দ করেছেন, কিন্তু প্রতিবেশী বন্ধুদেশের ওই সিদ্ধান্ত যে তাঁদের অপছন্দের, সে কথা ওই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝাতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হননি।
কেন অপ্রয়োজনীয়, তার অনেক কারণ নিশ্চিতই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জানাতে পারতেন। ভারত সরকারের কাছেও ‘কেন প্রয়োজনীয়’ সেই কারণেরও অভাব নেই। আমি ওই বিতর্কে ঢুকতে চাই না। কেননা, সিদ্ধান্তটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দৃষ্টিতেই এই ধরনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা চিহ্নিত হয়। আমি গোটা বিষয়টি অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখতে আগ্রহী। আমার কাছে দেশের অর্থনীতির নিরিখে সিএএ, এনআরসি অথবা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার বা ‘এনপিআর’ ভস্মে ঘি ঢালারই নামান্তর। বিপুল অর্থের অপচয় ছাড়া এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অন্য কিছু নয়।
‘কেস স্টাডি’ হিসেবে আসামের এনআরসিই যথেষ্ট। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যে চার বছর ধরে এনআরসি নামক যে রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, তার প্রশাসনিক খরচ দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি রুপি। এই রাজ্যের জনসংখ্যা কমবেশি ৩ কোটি ৩০ লাখ। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, ১৯ লাখের মতো মানুষ এনআরসির জালে আটকা পড়েছে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তারা প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। এই সব প্রশ্নবিদ্ধ মানুষের ভবিষ্যৎ কী, সরকার এখনো তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাদের ‘ট্রাইব্যুনালের’ দ্বারস্থ হওয়ার কথা। অথচ চার মাস কেটে গেছে, এখনো কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এর প্রধান কারণ, বিদেশি বাছাইয়ের জন্য যারা কোমর কষে এনআরসি নিয়ে আসরে নেমেছিল, তারাই বিস্ফারিত নেত্রে দেখেছে ১৯ লাখের মধ্যে ১২ লাখই হিন্দু অথবা ‘অ-মুসলমান’! সেই তারাই এই এনআরসিকে বর্জন করেছে। সারা দেশের সঙ্গে নতুনভাবে আসামেও আরও একবার এনআরসির দাবি জানিয়েছে। কী করে হিন্দুদের ধরে রেখে মুসলমানদের ওপর কোপটা ফেলা যায়, সেই ফন্দি-ফিকির আঁটা হচ্ছে। গোটা রাজ্য এই নিয়ে আপাতত টালমাটাল।
নিট রেজাল্ট? এনআরসির জন্য আসামে যত টাকা খরচ হয়েছিল, সবটাই বিলকুল বরবাদ! পণ্ডশ্রম ছাড়া ওই উদ্যোগের আর কোনো বিশেষণ নেই!
খরচের বহরটা কেমন? আসামে এনআরসির কাজে লাগানো হয়েছিল ৫২ হাজার কর্মী। তাঁদের বেতন ও ভাতা সম্ভবত প্রশাসনিক খরচের মধ্যে পড়ছে। বাড়তি খরচ বলতে ট্রাইব্যুনাল গঠন। সরকারি ঘোষণা, এক হাজার ট্রাইব্যুনাল খোলা হবে। তার প্রশাসনিক খরচ আছে। ১৯ লাখের মধ্যে যারা চূড়ান্তভাবে ‘অ-নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত হবে, তাদের বন্দিশিবির বা ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ রাখা হবে। সে জন্য জেলায় জেলায় শিবির খুলতে হবে। সেই সব শিবির হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। আপাতত রাজধানী গুয়াহাটির অদূরে একটি মাত্র বন্দিশিবির তৈরির কাজ প্রায় শেষ। সেখানে জায়গা হবে ৩ হাজার জনের। মঞ্জুর হয়েছে ৪৫ কোটি রুপি। এই ধরনের ১০০ শিবির তৈরি করা হলে খরচ পড়বে সাড়ে ৪ হাজার কোটি রুপি। ১৯ লাখের জন্য তাহলে কত খরচ? ২৯ হাজার কোটি। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘রেকারিং এক্সপেন্ডিচার’, তা অবশ্যই এই খরচের বাইরে।
আসামের সোয়া ৩ কোটি মানুষের জন্য এনআরসি তৈরির প্রশাসনিক খরচ ১ হাজার ৬০০ কোটি হলে ১৩০ কোটি মানুষের দেশের জন্য খরচের বহর ৫০ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়। বিজেপির নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা বারবার শুনিয়ে আসছেন, গোটা দেশে ‘বিদেশি’ রয়েছে কমবেশি দুই কোটি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সংখ্যাটা না হয় এক কোটি হবে। এই এক কোটি মানুষ, যারা এই দেশের শাসক দলের অন্যতম শীর্ষ নেতার ভাষায় ‘উইপোকা’, তাদের বাংলাদেশে ‘ঘাড় ধাক্কা’ দিয়ে ফেরত পাঠানো অসম্ভব। কারণ, ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ের দায় বাংলাদেশের হতে পারে না। তা ছাড়া, বাংলাদেশের সরকারি অভিমত, সে দেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটে না। প্রয়াত হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তো সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশিরা সমুদ্র সাঁতরে ইউরোপ চলে যাবে, কারণ সেখানকার অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, তারা ভারতে যাবে না। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশি শক্তিশালী।’ এই এক কোটি ‘অ-নাগরিকের’ জন্য তাহলে কত বন্দিশিবির প্রয়োজন? তার খরচ কত? আসামের হিসাব ধরলে অঙ্কটা দেড় লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে!
অতএব, সারা দেশে এনআরসির প্রশাসনিক খরচের সঙ্গে এক কোটি লোককে ধরে রাখার খরচ জুড়লে মোট হিসাবে দুই লাখ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবার এই সব মানুষকে রাষ্ট্রকে খাওয়াতে-পরাতে হবে। সরকারি হিসাবে একজন বন্দীর মাসিক খাওয়া খরচ কম করে দেড় হাজার টাকা। অর্থাৎ, বছরে ১৮ হাজার টাকা। তাহলে এক কোটি বন্দীর বাৎসরিক খাওয়া খরচ কত? সেই অঙ্কটা কষে নিন এবং দুই লাখ কোটির সঙ্গে যোগ করুন। তারপর ভেবে দেখুন, বিদেশি বাছাইয়ের গোঁ রাখতে এই সরকারের কতগুলো ‘গৌরী সেনের’ প্রয়োজন!
এনআরসির সবচেয়ে বড় দাবিদার যে বিজেপি, আসামের চূড়ান্ত ফলকে অস্বীকার করেছে, সারা দেশের এনআরসিও যে তারা প্রত্যাখ্যান করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? আসামে অত টাকা জলে গেলে গোটা দেশের টাকারও যে গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে না, তাই–বা কে বুক ঠুকে বলতে পারে?
আরও একটি বিষয়ও ভাবা প্রয়োজন। আসামের ওই ১৯ লাখ মানুষের জন্য এত দিন সরকারকে কিন্তু একটা কানাকড়িও খরচ করতে হয়নি। গোটা দেশের ‘কল্পিত দুই কোটি বিদেশির’ জন্যও একটা ফুটো পয়সা সরকারকে খরচ করতে হচ্ছে না। নিজেদের পেট, পরিধান, মাথার ওপরের ছাদের ব্যবস্থা তারা কিছু না কিছু করে নিজেরাই চালিয়ে নিচ্ছে। ভারতের সম্পদ সৃষ্টিতে সাহায্য করছে। বিদেশি চিহ্নিত হলে তাদের ভাত-কাপড়ের সব দায় কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে। অর্থাৎ, সরকারি কোষাগারের ওপর অতিরিক্ত চাপ।
নাগরিকদের অর্থ অপচয়ও কি কম? আসামের নাগরিকদের বারবার পরিচয়পত্র নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। নথি জোগাড়, দালালি ও ঘুষ বাবদ অজস্র টাকা খরচ করতে হয়েছে। একটা হিসাব অনুযায়ী, আসামের নাগরিকদের এই দৌড়ঝাঁপের জন্য গড়ে মাথাপিছু ১৯ হাজার টাকা করে খরচ করতে হয়েছে। এই টাকা দেশের সম্পদ সৃষ্টির সহায়ক হয়নি। আসামের আলোয় এবার গোটা দেশের ছবিটা আঁকুন এবং প্রশ্ন করুন, এই বিলাসিতা ভারতবাসীর সাজে কি না।
ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন, তাঁরা সিএএ ও এনআরসির ওপর নজর রাখছেন। ভারত আপাতত এই নিয়েই উত্তাল। অস্থিরতা কখনো অর্থনীতির সহায়ক হয় না।
এই কথাই অন্যভাবে বোঝাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রশ্ন তুলেছেন সিএএ ও এনআরসির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। অনধিকার চর্চা? ভারত মনে করতেই পারে। কিন্তু অযৌক্তিক কি? ভেবে দেখা দরকার।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি