ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সম্প্রতি জাতীয় নগদকরণ (মনিটাইজেশন) রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। এতে চার বছরে ছয় লাখ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ জন্য রেল, জাতীয় সড়ক, বিদ্যুৎ উৎপাদন, টেলিকমের মতো রাষ্ট্রমালিকানাধীন সম্পদ ২৫ বছরের জন্য বেসরকারি খাতে বন্ধক দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের রাজনীতিকেরা যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নগদকরণের নতুন এ নীতির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। সরকারি শিবির দাবি করেছে, এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর নেতারা অভিযোগ করেছেন, এটা জাতীয় সম্পদ বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেওয়ার চক্রান্ত। নিঃসন্দেহে ভারতজুড়ে এর কড়া সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু যেসব পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাজনীতিকেরা বিরোধিতা করছেন, সেগুলো আরও ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
প্রথমত, বিরোধী নেতারা যেভাবে এ ঘটনাকে জাতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার চক্রান্ত বলে শোর তুলেছেন, সেটা অতি সরলীকরণ। তাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, ২৫ বছর বন্ধক দেওয়া মানে বিক্রি করে দেওয়াই। কিন্তু বেশির ভাগ বিরোধী নেতা, বিশেষ করে কংগ্রেসের নেতাদের এ যুক্তি যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার এই প্রকল্প নয়া উদার অর্থনৈতিক নীতির প্রতিফলন। ভারতে এই নীতি প্রথম কংগ্রেস সরকারের আমলেই গ্রহণ করা হয়েছিল। বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতার এই ধরন, শেষ পর্যন্ত একধরনের ভণ্ডামি।
সমালোচনা করতে গিয়ে বেশির ভাগ জননেতা ও বুদ্ধিজীবী এমন সব রূপকল্প ব্যবহার করছেন, যেগুলো ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে তাঁরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বন্ধক দেওয়ার এ ঘটনার সঙ্গে ‘রাজকীয় রত্নভান্ডার’ কিংবা ‘পারিবারিক রৌপ্যভান্ডার’ বিক্রি করে দেওয়ার তুলনা করেছেন। বেশির ভাগ গণমাধ্যম সম্পদ নগদকরণের এই বিতর্ককে তুলে ধরতে শিরোনামে এই দুটি রূপকই ব্যবহার করেছে।
অর্থনৈতিক অংশীদার হিসাবে দলিত, মুসলমান ও আদিবাসীরাও রেলের সুবিধা ভোগ করে। ২০২০ সালে রেলের মোট জনবলের ২৫ শতাংশ আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের লোকদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে গেলে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের এ নীতি তারা মানবে না। ফলে নিম্নবর্ণের লোকদের আরও প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হবে।
ঐতিহাসিকেরা জানেন যে ‘পারিবারিক রৌপ্যভান্ডার বিক্রি’ করার রূপকটি সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচারের আমলে নেওয়া বেসরকারীকরণ নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। ১৯৮০-এর দশকে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের নেওয়া বেসরকারীকরণ নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে উক্তটি প্রথম করেন। ঐতিহ্যগতভাবে একজন টোরি নেতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেসরকারীকরণ নীতির সমালোচনা যে উদ্দেশ্য থেকে ম্যাকমিলান করেছিলেন, ভারতের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সেটার কোনো মিল নেই।
শুধু এ ঘটনা নয়, ভারতের শাসকশ্রেণির অভিজাতেরা যেকোনো ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে জনসমাজের শিকড়ে প্রোথিত আছে, এমন কোনো শব্দ-রূপক খুঁজে পান না। উন্নয়নের ধারণা হোক কিংবা বিরোধিতা করার ঘটনা, সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁরা পশ্চিম থেকে, বিশেষ করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে শব্দ ও অলংকার ধার করেন। তাঁরা চেতনে হোক বা অবচেতনে, ঔপনিবেশিক খোঁয়ারি এখনো কাটাতে পারেননি।
বিষয়টা শুধু ঘটনার বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের অভিজাত শ্রেণি কীভাবে তাদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ করে, এটা তারও প্রতিফলন। ভারতের অর্ধেকের বেশি মানুষ নিম্নবর্ণের। স্বর্ণালংকার পরলে এখনো উচ্চবর্ণের লোকদের হাতে তাদের পিটুনির শিকার হতে হয়। বেশির ভাগ ভারতীয়ের কাছে সম্পদ রাখা যখন অপরাধ, তখন ‘পারিবারিক রৌপ্যভান্ডার’-এর মতো রূপকল্প ব্যবহার করা পুরোপুরি অযৌক্তিক।
ভারতের অভিজাত শ্রেণি যে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, এটা তারই একটা দৃষ্টান্ত।
তত্ত্বগতভাবে, ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে বর্ণ-শ্রেণি-লিঙ্গনির্বিশেষে সবার সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু ‘রাজকীয় রত্নভান্ডার’ কিংবা ‘পারিবারিক রৌপ্যভান্ডার’ শুধু সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির বিষয়। এই সাধারণ বৈপরীত্য বোঝার ক্ষমতা ভারতের অভিজাত জননেতা কিংবা বুদ্ধিজীবীর নেই। প্রস্তাবিত রূপরেখায় ৫২ শতাংশ আয় আসবে রেলপথ (২৫ শতাংশ) ও সড়ক (২৭ শতাংশ থকে। ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় খাত রেল। এ খাত অবশ্য বৈষম্যমুক্ত নয়। তবে অর্থনৈতিক অংশীদার হিসাবে দলিত, মুসলমান ও আদিবাসীরাও রেলের সুবিধা ভোগ করে। ২০২০ সালে রেলের মোট জনবলের ২৫ শতাংশ আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের লোকদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে গেলে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের এ নীতি তারা মানবে না। ফলে নিম্নবর্ণের লোকদের আরও প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হবে।
ভারতের যে জাতীয় মহাসড়ক ব্যবস্থা, সেখানে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য এমনিতেই প্রবল। নতুন রূপরেখায় এ বৈষম্য আরও তীব্র হবে। সরকারের হাতেই যখন মহাসড়কের দায়িত্ব, তখনই মহাসড়ক বানাতে গিয়ে দলিত ও আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। প্রতিবেশী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের জমি অক্ষত থেকে যাচ্ছে। আবার মহাসড়কে যে চার চাকার যান চলাচল করে, সেগুলোর মালিক উচ্চ শ্রেণি। নিম্নবর্ণের মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে তাদের শ্রমেই মহাসড়ক বানানো হচ্ছে, অথচ তাদেরই আর্থসামাজিক অংশীদারত্ব থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন নীতিতে এটা বহু গুণ বেড়ে যাবে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
তমোঘ্ন হালদার ভারতের আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক