ভারত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে
১৯৯১ সালে ভারত সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করার পর বিশ্বে দেশটির মর্যাদা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। দেশটি ইতিমধ্যে একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্র এবং একটি মুক্ত সমাজে কীভাবে বৈচিত্র্যময়তাকে স্থান দিতে পারে, বিশ্বে তার একটি উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ভারত তার বাজার উন্মুক্ত করে দেয়, যার ফলে বিশ্বনেতারা নয়াদিল্লি সফরের জন্য এমন উন্মুখ হয়ে ওঠেন যে একসময় তাঁরা কূটনৈতিক প্রটোকল কর্মকর্তাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতের সেই মর্যাদায় ধস দেখা দিয়েছে। ভারত ক্রমে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। এর কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিভাজনমূলক ও সামাজিকভাবে বৈষম্যমূলক নীতি এবং এর সঙ্গে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব ও আচরণ এই পতনের জন্য দায়ী।
২০১৬ সালের নভেম্বরে আচমকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে এবং ২০১৭ সালে ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স’ নামে নতুন একটি কর আরোপ করে নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছে। এই দুটি সিদ্ধান্ত বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে পথে বসিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষকে বেকার করেছে, যা ভারতীয় সমাজকে আরও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এবং এই অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণে বিজেপি ক্ষমতায় টিকে থাকতে আবার ধর্মীয় উন্মাদনাকে সামনে নিয়ে আসে।
২০১৮ সালে বিজেপি ইসলামি শরিয়াহর তিন তালাক প্রথাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে তা বাতিল করেছে। ২০১৯ সালে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দেয়; এ ছাড়া অযোধ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের স্থানটি হিন্দুদের দিয়েছে এবং কেবল তিনটি প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থী এবং অভিবাসীদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে।
এসব পদক্ষেপ ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকে বিকৃত করেছে। দিল্লি ও উত্তর প্রদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী সরকারের নৃশংস আক্রমণ ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে এবং ভারতের এত দিনের সুনামকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের মতো প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে ভীষণভাবে বিব্রত করেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ও মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্যদের বিক্ষুব্ধ করেছে। প্রধান বিদেশি সংবাদপত্রগুলো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারত সম্পর্কে সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। প্রতিদিনের রিপোর্টিং এবং মতামতগুলোও ছিল নেতিবাচক। দেশের ভেতরেও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন সংশোধনকে একটি ‘স্ব-আরোপিত লক্ষ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা ভারতকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ফলে দেশটিকে পাকিস্তানের মতো অসহিষ্ণু রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, সরকারের বিভাজনমূলক নীতি আমাদের শত্রুদের ‘আমাদের ওপর আক্রমণ করার প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে’ এবং প্রবাসী ভারতীয়দের একটি অংশ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কিছু চরম ডানপন্থী সদস্য ছাড়া ভারতের প্রতি আর কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থন নেই।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার ও শরণার্থীবিষয়ক সংস্থাগুলোর প্রধানরাসহ বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতা মোদি সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোর সমালোচনা করেছেন। ৪০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে আলোচনা করা হয়েছে।
এগুলো ভারতের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, ভারত বহিরাগত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রয়োজন, যা দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে। বিশ্ব ক্রমেই ভারতকে অসহিষ্ণু, সংকীর্ণ মনের দেশ হিসেবে দেখছে।
ভারতীয় অর্থনীতির বাজে পারফরম্যান্স এবং তার ঘরোয়া রাজনৈতিক বিভাজন নতুন বৈদেশিক নীতির চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে এখন লাভ-ক্ষতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করছেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ভারতের চিরবৈরী প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের প্রতি তাঁর সমর্থন জোরদার করেছেন। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে ভারতের অবস্থানকে একসময় খুবই আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয়েছিল, অথচ এখন তা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী