বাঙালির প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের সঙ্গে মিশে থাকা শতাব্দীপ্রাচীন দুটি ঐতিহ্যবাহী লাইন হলো, ‘আই ইট রাইস’ এবং ‘রাইস ইজ ইটেন বাই মি’। কারণ, বাঙালির ‘বাপের সম্পত্তি’ বলে যদি কিছু থাকে, তো তার নাম ‘ভাত’। সরু বা মোটা, আধা বা গোটা, আটাশে বা মিনিকেট, বাসমতি বা নাজিরশাইল—যে চালেরই হোক, বাঙালির থালায় চারটে ভাত থাকতেই হবে। আগের দিনে জমি-জিরেত আর ‘গোলা ভরা ধান’ ওয়ালারা তিন বেলা ভাত খেতেন। ‘নাশতা’ বলতে ছিল ‘উড়কি ধানের মুড়কি, শালি ধানের চিঁড়ে, বিন্নি ধানের খই’।
অন্যদিকে আসানসোলের মতো অজপাড়াগাঁয়ের হাভাতে দুখু মিয়ারা ভাত না পেয়ে রুটি বেলতেন। সেই রুটি খেতেন তিন বেলা ভাত না পাওয়া দুঃখী মুটে-মজুর। দিন খানিকটা বদলেছে। এখন যাঁদের হাতে কঁাড়ি কঁাড়ি পয়সাকড়ি, তাঁরা তিন বেলা ভাত খান না। তাঁদের খাওয়ার এবং পানের আরও ম্যালা জিনিস আছে। তাঁদের সামনে ফুলটাইম ফল-ফ্রুট, স্যান্ডউইচ, বার্গার, পিৎজাসহ নানা ধরনের ইংরেজি নামের খাবার থাকে। তাঁরা স্ন্যাক্স আর ড্রিংকসের পাশাপাশি ভাত খান এক বা দুই বেলা; তা–ও বড়জোর লোকমা দুয়েক। তবে ১৮ কোটি মানুষের দেশে এই কিসিমের পয়সাওলার মাইক্রোসকপিক সংখ্যা বের করতে দূরবীন লাগবে। এখনো বেশির ভাগ লোক গরিব বা মধ্যবিত্ত। তাঁদের হাতের নাগালে স্যান্ডউইচ-বার্গার থাকে না। এই কারণে ডায়াবেটিসের ব্যারামে না পড়লে তাঁরা তিন বেলা ভাতই খান। কারণ, ‘ফুলের সৌরভ নয়, ভাতের গন্ধ তাঁর অধিক প্রিয়’।
বিনা মেঘে ‘ঠাডা’ পড়ার মতো খবর হলো, হামাগুড়ির বয়সে অন্নপ্রাশন কিংবা ‘মুখে ভাত’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে ভেতো বাঙালির জীবনের শুরু, তাদেরই ‘ভাতের খোঁটা’ দিয়ে বসেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, বাইরের দেশের চেয়ে আমরা ডবল ভাত খাই বলেই নাকি চালের দাম বেড়ে গেছে। ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর: কৃষির রূপান্তর ও অর্জন’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আমরা অনেক বেশি ভাত খাই। যদি ভাতের এই কনজাম্পশন (খাওয়া) কমাতে পারি, তাহলে চালের চাহিদা অনেকটাই কমে যাবে। আমরা একেকজন দিনে প্রায় ৪০০ গ্রাম চাল খাই, পৃথিবীর অনেক দেশে ২০০ গ্রামও খায় না।’
এখন কথা হলো, ‘পৃথিবীর অনেক দেশের’ যে মানুষেরা দিনে ২০০ গ্রামও চাল খান না, তাঁরা ভাতের বাইরে আসলে কী খান? তাঁরা প্রচুর ফল, ভেজিটেবল সালাদ, মাছ-মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার খান। ফাস্ট ফুড হিসেবে পিৎজা, স্যান্ডউইচ, বার্গার, হটডগ খান। এত সব খাবারের পাশাপাশি তাঁরা যে ২০০ গ্রাম চালের ভাত খান, এটাই তো বিস্ময়কর কথা।
সীমাহীন লুটপাটের ওপর দাঁড়ানো একটা ভয়ানক অসম উন্নয়নের পিরামিড থেকে অর্থনৈতিক সুবিধার যে ছিটেফোঁটা চুইয়ে পড়ে, তাতে সর্বজনীন উন্নয়ন অধরাই রয়ে গেছে। অল্প কিছু মানুষের ঘরে আছে মাছ, মাংস, ফল, দুধসহ ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষের থালায় ভাত আর আলুভর্তা বা ছোট মাছ কিংবা শাক ছাড়া কিছু নেই।
আর আমরা, মানে ৮০ ভাগের বেশি বাংলাদেশি দিনে ৪০০ গ্রাম চালের যে ভাত খাই, তার বাইরে আসলে কী খাই? আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি, বেদানা—এগুলো আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে মূলত জ্বর-জারির পথ্যি। প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় এসব কয়জনের পাতে জোটে? এগুলো কেনার পয়সা যেহেতু নাই, তাই ‘ফল–ফ্রুটের’ মধ্যে সারা দিনে খাই কয়েক খিলি পান আর ‘ভাজা পোড়ার’ মধ্যে খাই কাপ কয়েক চা।
‘পৃথিবীর অনেক দেশের’ মানুষের যেমন ক্ষুধা লাগে, তেমনি এই দেশের মানুষেরও ক্ষুধা লাগে। বিদেশের ভাত কম খাওয়া মানুষের পাকস্থলীর পরিধি ও ধারণক্ষমতা যতটুকু, আমাদের তার চেয়ে কম না। বিদেশের সেই লোকদের সকাল শুরু হয় ব্রেকফাস্ট দিয়ে, এরপর ছোট ছোট খিদে মেটানোর জন্য স্ন্যাকিং থাকে। কাজের ফাঁকে বিস্কুটের কৌটো পাশে নিয়ে মুখ চালানোর সুযোগ থাকে। এরপর লাঞ্চ-ডিনারের ভারী খাবার তো থাকলই।
সীমাহীন লুটপাটের ওপর দাঁড়ানো একটা ভয়ানক অসম উন্নয়নের পিরামিড থেকে অর্থনৈতিক সুবিধার যে ছিটেফোঁটা চুইয়ে পড়ে, তাতে সর্বজনীন উন্নয়ন অধরাই রয়ে গেছে। অল্প কিছু মানুষের ঘরে আছে মাছ, মাংস, ফল, দুধসহ ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষের থালায় ভাত আর আলুভর্তা বা ছোট মাছ কিংবা শাক ছাড়া কিছু নেই। এ কারণে ফল, মাংস, দুধ না দিয়েই কেউ ভাত খাওয়া কমাতে বললে ভাত দেওয়ার মুরোদ না থাকা সেই কিল মারার গোঁসাইয়ের কথা মনে আসে
এ দেশে যে লোক সারাটা দিন রিকশা চালান কিংবা দশ–বারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেন, যে লোকের চাল কেনার বাইরে অন্য কিছু কেনার ক্ষমতা নেই, সেই লোকের তো বিদেশিদের মতো একটা পাকস্থলী আছে। তাঁরও তো খিদে লাগে। হাড়ভাঙা খাটুনির কারণে তিনি যে পরিমাণ ক্যালরি হারালেন, তা পূরণ করবেন কী দিয়ে? তাঁকে ওবেসিটির জুজু, ব্লাড সুগারের ভূত দেখিয়ে লাভ আছে? খিদে লাগলেই ভাত খোঁজেন।
মনে রাখা দরকার, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। ২০২০ সালে ছিল ৭৫ নম্বরে। তার মানে, দেশে ক্ষুধা বেড়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং বাংলাদেশ সরকারের করা যৌথ সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখনো ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ অর্থাৎ প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের পুষ্টিকর খাবার জোগাড়ের ক্ষমতা নেই।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ঈশ্বরী পাটনীর সামনে যখন ছদ্মবেশী দেবী অন্নপূর্ণা এলেন, তখন ঈশ্বরী পাটনী ‘আমার সন্তান যেন থাকে ফাস্ট ফুডে’ বলে বর চাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। ঈশ্বরী পাটনীর সেই প্রার্থনায় অন্নপূর্ণা ‘তথাস্তু’ বললেও আমাদের ‘দুধভাতে উৎপাত’ আজও থামেনি। এ কারণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের জয়নাব মরার সময় যখন অন্তিম ইচ্ছা হিসেবে শিশু সন্তান ওহিদুল্লাকে নিজ হাতে তুলে দুধভাত খাওয়াতে চেয়েছিল, তখন দুধ জোগাড় করতে না পেরে তার জা হামিদা পানিতে আতপ চালের গুঁড়া মিশিয়ে দুধের ধারণা সৃষ্টি করে জয়নাবের হাতে তুলে দিয়েছিল। মৃত্যুর আগমুহূর্তে দুধসদৃশ তরল পানীয়র সঙ্গে সাদা ভাত চটকে ওহিদুল্লাকে খাইয়েছিল জয়নাব।
এই গল্পগুলো ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই গল্প যাঁদের জীবন থেকে নেওয়া তাঁরা জানেন, ‘কত চালে কত ভাত’। সীমাহীন লুটপাটের ওপর দাঁড়ানো একটা ভয়ানক অসম উন্নয়নের পিরামিড থেকে অর্থনৈতিক সুবিধার যে ছিটেফোঁটা চুইয়ে পড়ে, তাতে সর্বজনীন উন্নয়ন অধরাই রয়ে গেছে। অল্প কিছু মানুষের ঘরে আছে মাছ, মাংস, ফল, দুধসহ ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষের থালায় ভাত আর আলুভর্তা বা ছোট মাছ কিংবা শাক ছাড়া কিছু নেই। এ কারণে ফল, মাংস, দুধ না দিয়েই কেউ ভাত খাওয়া কমাতে বললে ভাত দেওয়ার মুরোদ না থাকা সেই কিল মারার গোঁসাইয়ের কথা মনে আসে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক