বয়স চুরির মন্দ আইন

‘জনসংখ্যা গোলমাল ও বয়স চুরির বিপদ’ শিরোনামে জনাব হেলাল মহিউদ্দীন প্রথম আলোয় (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০) একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছেন। তারই সূত্র ধরে এ বয়ান। জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি নিয়ে তিন দশক ধরে বাংলাদেশে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে, তা যে কত রকম সমস্যা তৈরি করেছে, তার কিছু বিবরণ তিনি দিয়েছেন। সরকার তো বটেই, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ছাড়াও অনেকগুলো দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এই বিপুল কর্মযজ্ঞকে খুবই দরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু নানা গোঁজামিল আর আইনি মারপ্যাঁচে এই অতি দরকারি তথ্যভান্ডার যে নিত্যনতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, তা এখন সবাই মানছেন। তাই এখন ‘নির্ভুল জন্মনিবন্ধন’ নিশ্চিত করতে নতুন করে সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

লেখক জন্মনিবন্ধন ও স্কুলে জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে স্কুলশিক্ষকদের বা মা-বাবাকে যেভাবে দায়ী করেছেন, তা অর্ধসত্য। কেন জন্ম তারিখ সঠিকভাবে স্কুলে লেখা হয় না, সে বিষয়টি ভুলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এ নিবন্ধে।

স্কুলে জন্ম তারিখ লেখার জন্য দেশে প্রচলিত আইনই দায়ী এবং সে আইন ক্রমেই আরও জটিল করা হচ্ছে। একটু বিস্তৃত আলোচনা করা যাক। বিদ্যমান আইনে শিশুর বয়স ৫+ হলে তবে তাকে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করা যায়। সে হিসেবে পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষায় শিশুর বয়স হওয়ার কথা ১১ বছর। সে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে, আইন অনুযায়ী তার বয়স হবে ১১+। এই বিধানমতে, শিশু অষ্টম শ্রেণি পাস করবে ১৪ বছর বয়সে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবির বিধান বলছে, কোনো শিশুর বয়স ১২+ হলে তবেই সে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে। বয়স ১৪+ হলে যে কেউ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বয়সী যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু প্রাথমিক স্কুলের বিধান মানলে ১৬+এর নিচে কেউ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারে না। ওদিকে চাকরিতে প্রবেশের নিম্নতম বয়স ১৮ এবং সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর। বিয়ের বেলায় মেয়েদের বয়স লাগে ১৮, ছেলেদের ২১ বছর। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতেও সন্তানের বয়স লাগে ১৮ বছর। ভোটার হতেও এই ১৮ বছরের বিধান। শিক্ষা বোর্ডের আরেক আইনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের দুই বছরের মধ্যে জন্ম তারিখ সংশোধন করা যায়। এসব কারণে এ দেশের মানুষের আইনি সুবিধা নিতেই যখন যার যেমন দরকার পড়ে, সেভাবে বয়স কমানো-বাড়ানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। আর এ কারণেই ঢাকার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন অফিস আর শিক্ষা বোর্ডগুলোয় বয়স সংশোধনের জন্য লম্বা লাইন লেগেই থাকে।

আইনের এসব গ্যাঁড়াকলে পড়ে বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ শিশুর জন্ম তারিখই হয়ে পড়ে দুই নম্বরি। ফলে এ দেশের মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও এনসিটিবি কেন পড়ুয়াদের বয়সের এসব বদখদ আইন সংশোধন করছে না, সেটা একটা বড় রহস্য বটে। অর্থাৎ স্কুলে শিশুর জন্ম তারিখ বদলে দেওয়ার এই বদভ্যাসের মূলে এনসিটিবির কালো আইন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলে পড়ার জন্য একটি বয়সী কাঠামো দিতে পারে, কিন্তু বয়সের ফ্রেমে তার বিদ্যাভ্যাস বাধ্যতামূলক করার এই কালো আইন অবিলম্বে রদ করা উচিত।

আমাদের দেশে জন্মনিবন্ধনপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং মাধ্যমিক সনদপত্রে যে জন্ম তারিখ লেখা থাকে, তা আইনত মান্য করা হয়। এখন প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি সনদেও পড়ুয়ার জন্ম তারিখ লেখা থাকলেও সেটি অত গুরুত্ব বহন করে না। তবে অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদে চাকরির জন্য জেএসসি সনদে লেখা জন্ম তারিখ গুরুত্ব বহন করে।

জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র—দুটি আলাদা কর্মযজ্ঞ। জন্মনিবন্ধনের কাজটি করে ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের কমিশনার অফিসে। সারা বছরই জন্মনিবন্ধন বা তা সংশোধন করা যায়। আর জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজটি করে নির্বাচন কমিশন। সেটি তারা ঘোষণা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে করে। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বা মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদপত্র দেখাতে হয়। পাসপোর্টে জন্ম তারিখ লেখার জন্যও জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র বা এসএসসি পাসের সনদ (যেকোনো একটি) দরকার হয়।

বাংলাদেশে এখন জাতীয় পরিচয়পত্র সবচেয়ে মূল্যবান দলিল হিসেবে গণ্য। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র একটি অসম্পূর্ণ দলিল। এটি প্রথম তৈরি করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার সময় ভোটার কার্ড হিসেবে। সে কারণে বহু পরিচয়পত্রে নাগরিক যে নির্বাচনী এলাকায় বসবাস করেন, শুধু সেখানকার ঠিকানা দেওয়া আছে। সেখানে নাগরিকের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা নেই, সে সুযোগও নেই। ফলে অনেক জরুরি সেবার দরকারে এই কার্ড কাজে লাগে না। তা ছাড়া গোড়াতে এ পরিচয়পত্র তৈরিও করা হয়েছিল শুধু ভোটার পরিচয়পত্র হিসেবে, জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে নয়। অর্থাৎ ভোটার পরিচয়পত্রকে যে পরে জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, সেটি তখন কর্তাদের মাথায় ছিল না।

স্থানীয় সরকারের অফিসে জন্মনিবন্ধন সহজেই সংশোধন করা গেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করা খুব জটিল ও ব্যয়বহুল একটি কাজ। তা ছাড়া কাজটি একমাত্র ঢাকায় করতে হয়, যদিও ইউনিয়ন বা পৌর কর্তৃপক্ষের সনদ লাগে।

উল্লেখ করা দরকার, দুনিয়ার কোনো দেশে শিশুর জন্ম তারিখ ইচ্ছেমতো বদলের কোনো আইন নেই। শিশু জন্মের পর স্থানীয় সরকারের অফিসে নিবন্ধিত জন্ম তারিখই চূড়ান্ত এবং সে ক্ষেত্রে জন্মসংক্রান্ত চিকিৎসকের সনদই একমাত্র গ্রাহ্য দলিল।

ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের ইউনিয়ন বোর্ড এবং থানায় নাগরিকদের জন্ম-মৃত্যুর রেকর্ড রাখা হতো। এখনো সে আইন বহাল আছে। কিন্তু তা কেউ আমল করে না। সেটি কার্যকর করা হোক কঠোরভাবে। একটি ন্যাশনাল ব্যাকবোন সার্ভারে সে ডেটা সংরক্ষণ করে তা থেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে সব বিড়ম্বনার অবসান ঘটানো সম্ভব।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]