আমাদের দেশে এখন ব্যাংকিং ব্যবসা অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। এই ব্যবসাটি এতই সরল এবং সহজবোধ্য হয়ে গেছে যে ৪০০ কোটি টাকা মূলধন জোগাড় করতে পারলেই যে কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকিং ব্যবসার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। লাইসেন্স পাওয়া যেমন কঠিন নয়, ব্যবসাটাও যেন জলের মতো সোজা। তা না হলে ৫০টির কাছাকাছি ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও আরও নয়জন উদ্যোক্তা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন কেন? তাঁদের কল্যাণে দেশি-বিদেশি মিলে দেশে আজ ৫৭টি তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনীহা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠিত সর্বশেষ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের মধ্যে কয়েকটির কীর্তিকলাপ ইতিমধ্যে বহুবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। কয়েকটিতে বসাতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক। সমস্যাসংকুল একটি ব্যাংকের নানা কেচ্ছা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন নামীদামি পত্রিকায় ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে এমনও দাবি করা হচ্ছে যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মতো কাগজে ব্যাংকটি সম্পর্কে প্রশংসামূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
তবে ব্যাংকিং ব্যবসা যে কেবল সহজ হয়ে গেছে তা-ই নয়, আজকাল সব ধরনের ব্যবসাই খুব সহজ এবং লাভবান হয়ে উঠেছে। তা না হলে দেশে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব অনুযায়ী এ ছাড়া রয়েছে ২টি আন্তর্জাতিক এবং ২টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। আরও ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় নাকি সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়। শিক্ষা ব্যবসা যে সহজ হয়ে গেছে তার আরও প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় ২৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজের বিপরীতে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে ৬০ টি। অন্যদিকে ১টি সরকারি ডেন্টাল কলেজ ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরে শিক্ষার মান নিয়ে যেখানে সচেতন চিন্তাশীল মানুষ উদ্বিগ্ন, সেখানে নির্বিচারে বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় স্থাপন এই মানকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিদ্যাশিক্ষা নিয়েও যে ব্যবসা করা যায়, সেটি একসময় কল্পনাতীত ছিল। উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটলেও ন্যূনতম একটা মান বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়, যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। সম্প্রতি প্রাথমিক স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় ভুল ইংরেজিতে কণ্টকিত প্রশ্নপত্র থেকেই প্রশ্নকর্তাদের জ্ঞান এবং আমাদের অধোগামী শিক্ষার মানের প্রমাণ মেলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই গলদপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় মাশুল গুনতে হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরিবর্তে প্রতিবছর দলে দলে ‘সাদা কলার’ বেকার উৎপাদন করা ছাড়া এই বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কী অবদান রাখছে তার সঠিক মূল্যায়ন কে করবে?
কয়েক বছর আগে ইতালির ভেনিসে চট্টগ্রামের এক বেকার ভাগ্যান্বেষী তরুণকে পাওয়া যায় খণ্ডকালীন গাইড হিসেবে। ওর সঙ্গে একই মেসে থেকে রেস্তোরাঁয় কাজ করে এমন কয়েকজনের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখে উপদেশ দিয়েছিলাম, ওর যেহেতু বাঁধা কোনো কাজ নেই, এদের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটা কাজ করলেই পারে। এ কথায় ও একটু আহত হয়, কারণ ও একজন ‘গ্র্যাজুয়েট’। কোথাকার গ্র্যাজুয়েট জানতে চাইলে ও চট্টগ্রামের উপজেলা পর্যায়ের একটা কলেজের নাম বলে। আমাদের ‘উচ্চশিক্ষিত’ নতুন প্রজন্মের এই মানসিকতা আরও উসকে দিয়েছে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো, যেখান থেকে মুড়ি-মুড়কির মতো বিবিএ-এমবিএ ডিগ্রি দেওয়া হয়।
কেবল ব্যাংকিং বা শিক্ষা ব্যবসা নয়, মুদ্রণ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যবসাও কি লাভজনক এবং সহজ হয়ে ওঠেনি? দেশে এখন যে ৩০ টিরও বেশি টেলিভিশন চ্যানেল সদর্পে পর্দা কাঁপিয়ে চলছে, তাদের দর্শকসংখ্যা কত, আয় কেমন তার সঠিক হিসাব আমরা না জানলেও কোথাও নিশ্চয়ই আছে। লাভজনক না হলে বছরের পর বছর এগুলোর মালিকেরা চালাচ্ছেন কীভাবে? লোকসানে চালালেও কেন চালাচ্ছেন? আর ডিক্লারেশন পাওয়া পত্রিকার সংখ্যা যে আসলে কত, সেটা বোধ করি স্বয়ং তথ্য মন্ত্রণালয়েরও জানা নেই।
কয়েক বছর আগে হুজুগ শুরু হয়েছিল টেলিফোন ব্যবসার। সরকারি কোম্পানি বিটিসিএল ছাড়াও দেশে মোট ১১টি পিএসটিএন কোম্পানিকে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং গ্রামীণ টেলিফোন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটি মাত্র কোম্পানি চালু আছে। তারপর এসেছে বিভিন্ন ধরনের টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসা। ২০১২ সালে মোট ২৪টি আইজিডব্লিউ, ২২টি আইসিএক্স, ৩৬টি আইআইজি ও ৪১টি আইপিটিএসপি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া এসব উদ্যোগে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ উদ্যোক্তার এই ব্যবসা সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা ছিল না। এগুলোর সব চলমান আছে কি না, ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে কি না, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
লাভের আশায় যেকোনো ধরনের ব্যবসায় হুমড়ি খেয়ে পড়ার বিষয়ে আমাদের সহজাত প্রবণতার আরও বহু নজির তুলে ধরা যায়। আশির দশকের শুরুতে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প খাতে কয়েকজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোক্তার সাফল্য দেখে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা দলে দলে এই ব্যবসায় নেমে পড়েন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কী হাল হয়েছে তার হিসাব কেবল অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর কাছেই আছে। সেই তখন থেকে শুরু করে হালের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, সমুদ্রগামী মাছধরা ট্রলার-সর্বক্ষেত্রেই আমরা পূর্বাপর না ভেবে নেমে পড়ি। সহজে ধনশালী হওয়ার জন্য কেবল হুজুগে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া যেকোনো ব্যবসায় নেমে পড়ার মাশুল কেবল যে উদ্যোক্তাদের দিতে হয় তা নয়, অর্থ লগ্নিকারী ব্যাংককেও এই ক্ষতির ভাগ নিতে হয়। আমরা হার্ডওয়্যার ব্যবসায় গুজরাতি বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষের লেগে থাকা কিংবা মাড়োয়ারিদের নির্দিষ্ট কয়েকটা ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করে পুরুষানুক্রমে সেটিতে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার বিষয়টি দেখেও কিছু শিখতে পারিনি।
ব্যাংকিং ব্যবসা যে খুব সহজ, এই বক্রোক্তি দিয়ে শুরু করার পর যখন খবরে জানা যায় যে বহুল আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের পতনোন্মুখ পরিস্থিতির পরও আরও তিনটি নতুন ব্যাংক সরকারের আনুকূল্যে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, তখন এই কথাটি আর ব্যঙ্গাত্মক থাকে না। ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান যে হাল, নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোই যে কেবল তার পরিণতি ভোগ করবে তা নয়, অন্যান্য ব্যাংকের ওপরও তার প্রভাব পড়তে পারে।
দেশের অর্থনীতির তুলনায় প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাংকের উপস্থিতির প্রথম বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায় দক্ষ জনশক্তির অপ্রতুলতার ভেতর। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতাহীন জনবল ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ব্যাংকগুলো ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ঋণ তদারকি এবং খেলাপি ঋণ আদায়, সিন্ডিকেশন, বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে অনুভূত হচ্ছে দক্ষ লোকবলের অভাব। এ কারণে ঋণ প্রস্তাব বিশ্লেষণ এবং অনুমোদনে বিচক্ষণতার কোনো প্রতিফলন নেই। কেবল বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বিচারে ঋণদানের সহজতম পন্থায় ব্যাংকগুলো নিজ নিজ ব্যালান্সশিটে দায় ও সম্পদ বৃদ্ধি করে মুনাফা স্ফীত করার অবকাশ পাচ্ছে।
বড় নামী প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি নেবে না, কেবল এই বিবেচনায় ন্যূনতম যাচাই-বাছাই না করেই তাদের নামে অনুমোদন করা হচ্ছে বড় অঙ্কের ঋণ। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান প্রায় সব ব্যাংক থেকে সহজে পেয়ে যাচ্ছে নিম্নতম সুদে প্রয়োজনাতিরিক্ত ঋণসীমার সুবিধা। সেই ঋণসীমা ব্যবহার করে অন্য ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি ঋণ অনায়াসে পরিশোধ করে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে তারা। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় ঋণ পরিশোধ করার কথা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়লব্ধ আয় থেকে। স্বল্পমেয়াদি এসব ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে এসব বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাড়তি পাওনা হিসেবে পেয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় ‘সুবোধ গৃহীতা’দের জন্য প্রযোজ্য প্রদত্ত সুদের ওপর বিশেষ রেয়াত। অথচ ‘সুবোধ গ্রহীতা’দের জন্য সুদ ফেরত রেয়াতের মূল অভিপ্রায় ও লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ব্যবসা বা উৎপাদন থেকে অর্জিত প্রকৃত আয় দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধকে উৎসাহিত করা। এই শ্রেণির গ্রহীতারা বড় গ্রহীতাদের মতো ব্যাংকের সঙ্গে সুদের হার নিয়ে দর-কষাকষি করতে পারেন না বলে তাঁদের ওপর ধার্য সুদের হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
অন্যদিকে একাধিক ব্যাংকে ঋণসুবিধা থাকে না বলে এসএমই শ্রেণির প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পরিশোধের একমাত্র উৎস তাদের বিক্রয়লব্ধ আয়, তাই খুব কম ক্ষেত্রেই এসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত শর্ত পালনে সক্ষম হয়। আর সে কারণে এই শ্রেণিভুক্ত গ্রহীতারা ‘সুবোধ গ্রহীতা’র স্বীকৃতি কিংবা সুযোগ পান না। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজে বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়ে ব্যাংকের ব্যালান্সশিটের আকার দ্রুত বড় করা যায় বলে শত প্রণোদনাতেও ব্যাংকগুলোকে এসএমইমুখী করা সম্ভব হয়নি।
একটি কথা আমরা ক্রমেই বিস্মৃত হচ্ছি যে ব্যবসা ও শিল্পায়নের জন্য ব্যাংকঋণের বিকল্প এবং বাঞ্ছিত পন্থা হচ্ছে শেয়ার ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করা, কিন্তু বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই পন্থা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। কারণ, ব্যাংকঋণ যত সহজে এবং সস্তায় পাওয়া যায়, শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ তত সহজ নয়। উপরন্তু মূলধন জোগানদাতা শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ভাগাভাগি করে নিতে হয়, যার হার ব্যাংকঋণের সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি। তাই উদ্যোক্তারা পারতপক্ষে এ পথ মাড়ান না। বড় শিল্পোদ্যোগে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করার জন্য উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ এবং বাধ্য করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ব্যাংকের ওপর থেকে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পঋণের চাপ কমানো যায়।
আমাদের ব্যাংক এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রবণতা থেকে আবারও বলা যায়, সাধারণ ধারণায় অন্যান্য ব্যবসার মতো আজকাল ব্যাংকের ব্যবসা সত্যিই সহজ হয়ে পড়েছে যেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে এবং সরকারের তরফে কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করলে দেশের ব্যাংকিং ও আর্থ খাতে নেমে আসবে বড় বিপর্যয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail. com